আদালত প্রতিনিধি, মানিকগঞ্জ॥
মানিকগঞ্জ বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালতে দায়েরকৃত একটি ঘোষণামূলক দেওয়ানী মোকদ্দমার (নং- ৬০/২০২৫) লিখিত জবাবে মূল বিবাদীপক্ষ বাদীগণের আরজিতে উত্থাপিত যাবতীয় দাবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। বিবাদীপক্ষ দৃঢ়ভাবে দাবি করেছে যে তারা নালিশী ভূমির বৈধ মালিক ও শান্তিপূর্ণ দখলকার এবং এস.এ. ও আর.এস. রেকর্ডসমূহ কোনোপ্রকার ত্রুটি বা ভ্রম ছাড়াই আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে।
মোকদ্দমার প্রেক্ষাপট ও প্রাথমিক আপত্তি
মামলার পক্ষসমূহ হলো:
বাদীগণ: মোঃ লুৎফর রহমান গং ৫ জন।
বিবাদীগণ: খলিলুর রহমান গং ১২ জন (১-১০ মূল বিবাদীগণ, ১১-১২ মোকাবেলা বিবাদীগণ)।
মূল বিবাদীগণ (১-১০) আদালতে লিখিত জবাবে জানিয়েছেন, বাদীগণ সম্পূর্ণ অসত্য ও ভুল তথ্য উপস্থাপন করে আদালতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছেন। বিবাদীপক্ষের দাবি, বাদীগণ ঘোষণামূলক প্রতিকার প্রার্থনা করলেও আরজিতে উপস্থাপিত তথ্যের ভিত্তিতে এই ধরনের প্রতিকার প্রাপ্তির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
নালিশী ভূমিতে বিবাদীগণের মালিকানা ও দখলস্বত্ব
বিবাদীগণ তাদের মালিকানার পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, নালিশী তপশীল বর্ণিত ভূমি (সি.এস. ৫০৫ ও ৫০৮ দাগের মোট ৫৭ শতক) সংক্রান্ত এস.এ. ৩১০ নং খতিয়ান এবং আর.এস. ৫২৪ নং খতিয়ান প্রস্তুতকালে তাদের পূর্বপুরুষ সেখ রহিম উদ্দিন বেপারী ওরফে রমেজ উদ্দিন বেপারীর নাম যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বাদীপক্ষ সেখ রহিম উদ্দিন বেপারীকে ‘নিঃস্বত্ববান ও নির্দখলীয় ব্যক্তি’ হিসেবে দাবি করলেও, বিবাদীগণ এটিকে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন। তারা দাবি করেন, সেখ রহিম উদ্দিন বেপারীই ছিলেন উক্ত ভূমির বৈধ খরিদ্দার ও দখলকার।
বিবাদীপক্ষের যুক্তি অনুযায়ী, বাদীগণ যদিও স্বীকার করেছেন যে সেখ রহিম উদ্দিন বেপারী ইং ০৮/০১/১৯৫৯ তারিখে একটি সাফকবলা দলিল মূলে মহাম্মদ ইছমাইল উদ্দিন বরাবর ৪৯ শতক ভূমি হস্তান্তর করেছিলেন, তবে বিবাদীগণ এই হস্তান্তর প্রক্রিয়াটিকে সন্দেহজনক বা আইনত ত্রুটিপূর্ণ বলে দাবি করছেন।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এস.এ. রেকর্ড (১৯৫৬-১৯৬২) এবং আর.এস. রেকর্ড (১৯৮০-এর দশক) উভয় ক্ষেত্রেই সেখ রহিম উদ্দিন বেপারীর নাম বহাল থাকা প্রমাণ করে যে রেকর্ড প্রস্তুতের সময়ও তিনি বা তার ওয়ারিশগণ নালিশী ভূমির দখল এবং বৈধ মালিকানার দাবি বজায় রেখেছিলেন। সেখ রহিম উদ্দিন বেপারীর ওয়ারিশ হিসেবে বিবাদীগণ (১-১০) নালিশী সম্পত্তির বৈধ মালিক এবং শান্তিপূর্ণ দখলকার।
বাদীগণের স্বত্বদখল সংক্রান্ত দাবির খণ্ডন ও তামাদি আইনের প্রশ্ন
বিবাদীপক্ষ বাদীগণের স্বত্বদখল সংক্রান্ত দাবিগুলো খণ্ডন করে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে:
দুর্বল খরিদমূলক স্বত্ব: বাদীগণ মহাম্মদ ইছমাইল উদ্দিনের কাছ থেকে স্বত্ব লাভ করার দাবি করেছেন। কিন্তু যেহেতু পরবর্তী জরিপগুলোতে (এস.এ. ও আর.এস.) সেখ রহিম উদ্দিন বেপারীর নাম বহাল আছে, সেহেতু মহাম্মদ ইছমাইল উদ্দিনের স্বত্বই দুর্বল ও বিতর্কিত। দুর্বল স্বত্বের উপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত এওয়াজনামা বা সাফকবলা দলিলের মাধ্যমে বাদীগণ কখনই নিরঙ্কুশ স্বত্ব অর্জন করতে পারে না।
বণ্টননামার অকার্যকারিতা: বাদীগণ তাদের দাবিকৃত বন্টননামা দলিলকে (৭৬৬০ নং, ২৯/১০/১৯৯২) বিবাদীগণের প্রতি বাধ্যকর নয় বলে দাবি করেছেন। কারণ বিবাদীগণ উক্ত বন্টননামার পক্ষ ছিল না এবং এতে তাদের অধিকার উপেক্ষা করা হয়েছে।
দখল সংক্রান্ত বিতর্ক: বাদীগণ নালিশী ভূমিতে কমিউনিটি সেন্টার ও ওয়্যার হাউস নির্মাণের মাধ্যমে দ্বাদশ বর্ষের বহু ঊর্ধ্বে দখলের দাবি করলেও, বিবাদীগণ এই দখলকে আইনসম্মত বলে স্বীকার করেন না। বিবাদীপক্ষের ভাষ্য, রেকর্ডে নাম থাকা সত্ত্বেও তাদের অন্ধকারে রেখে বাদীগণ কোনো নির্মাণ কাজ করে থাকলে, তা তাদের নিজস্ব ঝুঁকি ও ব্যয়ে করা হয়েছে।
তামাদি আইনে বারিত: বাদীগণ ২০২৩ সালে পর্চার নকল সংগ্রহ করার পর ‘ভ্রমাত্মক’ রেকর্ডের বিষয়ে অবগত হওয়ার দাবি করেছেন। কিন্তু এস.এ. রেকর্ড ১৯৬০-এর দশকে এবং আর.এস. রেকর্ড ১৯৮০-এর দশকে প্রকাশিত হয়েছে। রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার নির্ধারিত সময়সীমার বহু পরে ঘোষণামূলক প্রতিকার চেয়ে মোকদ্দমা দায়ের করায়, বিবাদীগণ দাবি করছেন যে এই মোকদ্দমাটি তামাদি আইনের দ্বারা বারিত (Barred by Limitation)।
বিবাদীগণের প্রার্থনা
উপরে বর্ণিত কারণসমূহ এবং অন্যান্য আইনি যুক্তির ভিত্তিতে, বিবাদীগণ বিজ্ঞ আদালতের কাছে স-বিনয় প্রার্থনা জানিয়েছেন:
১. বাদীগণের আনীত ঘোষণামূলক মোকদ্দমা স-খরচা খারিজ করা হোক।
২. নালিশী ভূমিতে বিবাদীগণের স্বত্ব ও দখল বহাল রাখার আদেশ দেওয়া হোক।
৩. এস.এ. ও আর.এস. রেকর্ড সংশোধনের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হোক।
৪. বিজ্ঞ আদালতের বিবেচনায় বিবাদীগণ আর যে সকল প্রতিকার পাওয়ার হকদার, তা প্রদান করা হোক।