নিজস্ব ডেস্ক ॥
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যু নিয়ে গণভোট-এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ডেডলাইন রয়েছে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার নিশ্চিত করা হচ্ছে যে ফেব্রুয়ারিতেই এই দুই ভোট অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সব প্রতিনিধির কাছ থেকেও আসছে একই ঘোষণা। আজ নির্বাচনের তফসিল নির্ধারণের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে এবং সম্ভবত আজকেই তা চূড়ান্ত হবে। নির্বাচনের তারিখ চূড়ান্তকরণসহ সার্বিক বিষয় অবহিত করা ও সম্মতির জন্য ইসি আগামী ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোও পুরোদমে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে, বাইরে সবাই ‘পজিটিভ’ দেখালেও ভিতরে ভিতরে নির্বাচনকে ‘নেগেটিভ’ করার জন্য একটি মহল অত্যন্ত সক্রিয়-এমন ধারণা থেকেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় কাটছে না।
ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানোর তৎপরতা
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে নির্বাচনের বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকলেও, পরামর্শক অনেকের মধ্যে রয়েছে অনাগ্রহ। প্রথমবারের মতো ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া সরকারে থাকা কেউ কেউ ঘুঁটি উল্টাতে চান। তারা রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুকে সামনে এনে ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করতে আগ্রহী। মজার বিষয় হলো, নিজেদের মুখোশের আড়ালে রেখে তারাই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে উঁচু গলায় কথা বলছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে, যত দিন যাবে, এই গ্রুপ তত বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের ভিতরে থাকা এই অংশটি মুখে নির্বাচনের ফেনা তুললেও, ভিতরে তাদের তৎপরতা ভিন্ন। নির্বাচন বানচাল বা নির্বাচন পেছানোই তাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য গণভোটের ইস্যুটিকে ব্যবহার করা হতে পারে।
জটিল গণভোট ও সচেতনতার অভাব
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারে আনা জুলাই জাতীয় সনদ ৩০টি রাজনৈতিক দল ও তাদের জোটের মতামত নিয়ে তৈরি হয়েছে। এই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক থাকলেও, গণভোটের মতো কিছু বিষয়ে ঐকমত্যও তৈরি হয়েছে। তবে ‘উত্তর সহজ প্রশ্ন কঠিন’- এমন আদলে তৈরি গণভোট কাঠামোয় জনগণের রায় দিতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিষয়টি সহজভাবে নিচ্ছেন না। তাদের বক্তব্য, তৃণমূল পর্যায়ের জনসাধারণের কাছ থেকে কঠিন প্রশ্নে সহজ উত্তর পাওয়াটা বাস্তবসম্মত নয়। এমনকি এর সঙ্গে জড়িতরাও বিষয়টি জানেন। তারা মনে করেন, মাত্র দুই মাসের মধ্যে গণভোটে দেওয়া চারটি প্রশ্ন সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদেরও একই দাবি। এই অবস্থায় সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে গণভোট নিয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গণভোটের ইতিবাচক রায় নিয়ে শঙ্কা ও ঝুঁকির কথা জানিয়েছে।
রাজনীতিতে নতুন মোড় ও আদালতের শরণ
ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এখন রাজনীতির অন্যরকম মোড়ে অবস্থান করছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। শিগগিরই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে লন্ডন নেওয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এই পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল নির্বাচন পেছানোর দাবি জানিয়েছে। আবার একই দিনে নির্বাচন পেছাতে আদালতের আশ্রয়ও নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বিএনপি এরই মধ্যে ৩৬টি আসনে তাদের মনোনয়ন ঘোষণা করেছে, যা বিএনপির সমমনা দলগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তাদের মতে, আগামী কয়েক দিন দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের ভূত-ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়টিতে ঘটনার ঘনঘটায় অনেক কিছু ঘটতে পারে।
দেশি-বিদেশি শক্তির তৎপরতা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনের আগে নানা ধরনের ঘোলাটে পরিস্থিতি হতে দেখা যায়। এর সঙ্গে দেশি ও বিদেশি শক্তি জড়িত থাকে। কখনো কখনো ভিলেনরাও নায়কের ভূমিকায় পর্দায় আসেন। তাদের মতে, বর্তমান সরকারের মধ্যে একাধিক পাসপোর্টধারী অনেক নাগরিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো নির্বাচনটা হতে দিতে চান না এবং এজন্য তারা সব ধরনের তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ নিয়ে একাধিকবার অভিযোগও করা হয়েছে, তবে দলগুলো কারও নাম প্রকাশ করেনি।
উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি রক্ষার চাপ
সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছিলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই সংবিধান সংস্কার নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেছিলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রধান উপদেষ্টা যদি তাঁর এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারেন, তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে।