অনলাইন ডেস্ক ॥
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় সাভারের আশুলিয়ায় গুলি করে ছয়জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে ক্ষমা চেয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ আবজালুল হক।
বুধবার (১৯ নভেম্বর ২০২৫) বিচারপতি মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ রাজসাক্ষী হিসেবে এই জবানবন্দি দেন তিনি। বিবেকের তাড়না ও শহীদদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সত্য প্রকাশ করে বিচারিক কাজে সহায়তা করতে তিনি রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন এবং শহীদদের পরিবারসহ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চান।
যা বললেন রাজসাক্ষী আবজালুল
জবানবন্দিতে এসআই শেখ আবজালুল হক জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন আশুলিয়া থানার ওসি এ. এফ. এম. সায়েদকে তৎকালীন এমপি সাইফুল ইসলাম মোবাইল ফোনে আন্দোলন দমন ও বিরোধীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দিতেন। ওসি স্যার সেই নির্দেশনা অধস্তন কর্মকর্তাদের দিয়ে বাস্তবায়ন করতেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনা: গত ৫ আগস্ট সকালে তিনি অস্ত্রাগার থেকে পিস্তল ও গুলি নিয়ে থানার পশ্চিম পাশে দায়িত্বে নিয়োজিত হন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওসি সায়েদ হ্যান্ড মাইকে সবাইকে নিচে ডেকে শক্তভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন। এরপর তিনি বেশিরভাগ ফোর্স নিয়ে বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে যান।
গুলি চালানোর নির্দেশ: দুপুর আড়াইটার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর খবর ছড়িয়ে পড়লে ওসি সায়েদ ফোর্স নিয়ে থানায় ফিরে আসেন। বিকেল ৪টায় ছাত্র-জনতার একটি বিজয় মিছিল থানার দিকে এলে ওসি স্যারের সরাসরি নির্দেশে এএসআই বিশ্বজিৎ ও অন্য ইউনিট থেকে আসা কয়েকজন পুলিশ সদস্য মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যান।
লাশ গুমের প্রস্তুতি: তাৎক্ষণিকভাবে ওসি সায়েদ ফোনে ‘স্যার স্যার’ বলে পায়চারী করতে থাকেন। পরে তার নির্দেশে পুলিশ সদস্যরা পড়ে থাকা লাশগুলো ভ্যানে তুলে একটি পিকআপ ভ্যানে রাখেন। এ সময় ওসি সায়েদ এসআই আব্দুল মালেক ও এএসআই বিশ্বজিতের সঙ্গে পরামর্শ করছিলেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে এবং নার্ভাস বোধ করায় আবজালুল হক বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলে সিভিল পোশাকে পিস্তল নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো থানা থেকে বেরিয়ে যান।
লাশ পোড়ানো: তিনি জানান, ১৫ আগস্ট থানায় পিস্তল ও গুলি জমা দিতে গিয়ে জানতে পারেন-পুলিশ যাদের হত্যা করে পিকআপে রেখেছিল, সেসব লাশ ওইদিনই ওসি সায়েদ স্যার ও এএসআই বিশ্বজিৎ মিলে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেন। এরপর বিকেল সাড়ে ৫টায় তারা থানা ছেড়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে চলে যান।
ঊর্ধ্বতনদের নিষ্ক্রিয়তা: আবজালুল তার জবানবন্দিতে তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম, ঢাকা জেলার এসপি আসাদুজ্জামান রিপন, এডিশনাল এসপি (ক্রাইমস অ্যান্ড অপস) আব্দুল্লাহিল কাফি এবং অতিরিক্ত এসপি (সাভার সার্কেল) শাহিদুল স্যারদের এ ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখেননি বলে উল্লেখ করেন।
ক্ষমা ও আত্মসমর্পণের কারণ
চলতি বছরের মে মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এসআই শেখ আবজালুল হক বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে এই মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন। তিনি বলেন, “শহীদ ভাইদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কোনো ধরনের প্ররোচনা ও প্রলোভন ছাড়া এই মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য আবেদন করি। যেন ট্রাইব্যুনালকে এ মামলার বিষয়ে সত্য তথ্য দিয়ে বিচারকাজে সহায়তা করে শহীদ ভাইদের ঋণ কিছুটা পরিশোধ করতে পারি। আমি শহীদ ভাইদের জন্য কিছু করতে না পারায় তাদের পরিবার ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম
জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী রাজসাক্ষী আবজালুলকে আংশিক জেরা করেন। এরপর জেরা মুলতবি করে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর ২০২৫) আবার দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলার চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, নৃশংস এ ঘটনায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করা হয়। অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ বিচার শুরুর আদেশ দেন। এই মামলায় গ্রেপ্তার আট আসামির মধ্যে সাতজন নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও এসআই শেখ আবজালুল হক নিজের দোষ স্বীকার করে আসামি থেকে রাজসাক্ষী হলেন।