অনলাইন ডেস্ক ॥
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শনিবার (২৬ জুলাই) জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন শিক্ষার্থী জারিফ (১৩) এবং স্কুলের স্টাফ মাসুমা (৩২)। দুজনই লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। এ নিয়ে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ জনে।
হাসপাতালের চিত্র: ১৯ শিশু এখনো সংকটাপন্ন
সোমবারের বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ মোট ৫২ জনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল, যাদের ৭ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শরীর পুড়ে গিয়েছিল। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩৬ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এদের মধ্যে ৪ জন নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ), ৮ জন ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (এইচডিইউ) এবং ৮ জন পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে রয়েছেন। বাকিদের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কেবিনে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া, বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ ৪৮ জন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩৮ জন, ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ৮ জন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ জন এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১ জন রয়েছেন।
মৃতের সংখ্যা বিভাজন করলে দেখা যায়, বার্ন ইনস্টিটিউটে ১৭ জন, ঢাকা সিএমএইচে ১৫ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ জন, লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ১ জন এবং ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডে ১ জন মারা গেছেন।
চিকিৎসকদের উদ্বেগ: শ্বাসনালীর দহন ও সংক্রমণের ঝুঁকি
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক প্রফেসর ডা. মারুফুল ইসলাম জানান, সারা বিশ্বেই দগ্ধ রোগীদের ক্ষেত্রে অবস্থা সংকটজনক হয়, বিশেষ করে যদি শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, “পোড়া অংশগুলো ক্ষত হয়ে যায়, শিরা-উপশিরা প্রায় গলে যায়। রোগী শিশু হলে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।” তিনি আরও যোগ করেন, পোড়া ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি, যা ৫-১০ শতাংশ পোড়া ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রাণঘাতী হতে পারে।
প্রফেসর ইসলাম বলেন, “আমাদের বার্ন ইনস্টিটিউটে এই প্রথম এত শিশু ভয়াবহভাবে দগ্ধ হয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে ভর্তি অবস্থায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দিয়েছি এবং আমাদের সঙ্গে বিদেশি চিকিৎসকও সম্পৃক্ত হয়েছেন।” তিনি জানান, ২০ শতাংশের ওপর পোড়া কোনো দগ্ধ ব্যক্তিকেই শঙ্কামুক্ত বলা যায় না এবং মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে অধিকাংশ শিশু ও ব্যক্তির ২০ শতাংশের বেশি পোড়া রয়েছে, যাদের সবারই কমবেশি শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম বলেন, ৫ থেকে ১০ শতাংশ পোড়া ব্যক্তিরও শ্বাসনালী দগ্ধ হয়ে থাকে এবং প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার মতে, মানুষ সচেতন হলেই কেবল এমন ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তিনি এও বলেন যে শ্বাসনালী পোড়া ব্যক্তিদের বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ।
শোকে স্তব্ধ স্বজনরা: প্রশ্ন উঠছে নিরাপত্তা নিয়ে
শনিবার সকালে মারা যাওয়া জারিফ ফারহান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা হাবিবুর রহমান গভীর শোকে জানান, “সন্তানরা যদি স্কুলে নিরাপদ না থাকে, তাহলে কোথায় গেলে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে?” এই প্রশ্নটি যেন হাজারো অভিভাবকের মনের কথা।
এদিকে, শনিবার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে মারা যান স্কুলের কর্মচারী মাসুমা বেগম (৩৮)। তার স্বামী মো. সেলিম মিয়া জানান, মাসুমা মাইলস্টোন স্কুলে আয়ার কাজ করতেন এবং দুর্ঘটনার পরপরই তিনি শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েন। এক এক করে শিশুদের বাইরে আনতে গিয়ে তিনি নিজে গুরুতরভাবে অগ্নিদগ্ধ হন। সেলিম মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্টাফদের এমন করুণ মৃত্যুর দায় কে নেবে? এমন মৃত্যু তো স্বাভাবিক হয় না। ক্ষতিপূরণ কে দেবে? আর ক্ষতিপূরণ দিয়ে কি এতগুলো প্রাণ ফিরিয়ে আনা যাবে?”
বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়ার পরও শিশুদের বাঁচাতে পারছেন না। তিনি জানান, ১৭ জন মারা গেছেন এবং অনেকেই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় রয়েছেন। একাধিক মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তবে কিছু শিশুর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে এবং শনিবার দুজনকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। বিদেশি চিকিৎসক দলও কয়েকদিন ধরে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।