অনলাইন ডেস্ক॥
যে শহর কখনো ঘুমায় না—নিউইয়র্ক, যেখানে নানা জাতি, সংস্কৃতি আর ধর্মের মানুষ একসাথে বসবাস করে—এবার প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হলেন একজন মুসলিম মেয়র। তিনি শুধু মুসলিমই নন, একজন প্রগতিশীল, সাহসী ও সক্রিয় নেতা, যার নাম জোহরান কোয়ামে মামদানি। এই ঘটনা আমেরিকার গণতন্ত্রের সহনশীলতা ও বৈচিত্র্যকে আবারও প্রমাণ করলো। যখন সারা বিশ্বে ধর্ম, বর্ণ বা পরিচয়ের কারণে মানুষ বিভক্ত, তখন নিউইয়র্ক দেখালো একতা, সমতা এবং সবাইকে সুযোগ দেওয়ার এক উজ্জ্বল বার্তা।
জোহরান মামদানির বর্ণাঢ্য জীবন
জোহরান মামদানির জীবন এক সাহসী উদাহরণ। তিনি উগান্ডার কাম্পালায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা-মা ভারতীয় মুসলিম। মা একজন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বাবা অর্থনীতির শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই নিউইয়র্কের কুইন্সে বেড়ে উঠেছেন তিনি, স্থানীয় মানুষের সাথে মিশে তাদের জীবনযাপন দেখেছেন। পড়াশোনা করেছেন আফ্রিকানা স্টাডিজে এবং পরবর্তীতে দেউলিয়া হওয়া মানুষদের সাহায্য করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
রাজনীতির বাইরে তিনি একজন কবি, র্যাপার এবং শক্তিশালী বক্তা হিসেবেও পরিচিত। ২০২০ সালে তিনি নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। সেখানে তিনি সাশ্রয়ী আবাসন, পরিবহন, জলবায়ু এবং শ্রমিক অধিকার নিয়ে নিয়মিত কাজ করেছেন।
অভূতপূর্ব বিজয় ও অঙ্গীকার
যখন তিনি মেয়র নির্বাচনের জন্য নাম লেখান, তখন অনেকেই তাকে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন দ্রুত বাড়তে থাকে। তার প্রচারণার স্লোগান ছিল, “ন্যায়, মর্যাদা ও সবার জন্য সুযোগ”।
নির্বাচনী প্রচারে তিনি সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে নিয়ে বলেছিলেন, “আমি নিউইয়র্কের প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি—মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, কালো, সাদা, ধনী বা গরীব। এই শহর আমাদের সবার।” মেয়র হিসেবে তার প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো নিরাপদ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গৃহহীনদের জন্য মর্যাদা নিশ্চিত করা, পুলিশি সংস্কার, মানসিক স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা।
নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান
এক সাক্ষাৎকারে জোহরান মামদানি এক সাহসী ও দৃঢ় মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক আদালত অপরাধী ঘোষণা করেছে। তিনি যদি নিউইয়র্কে আসেন, আমি মেয়র হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করব এবং আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর করব।” এটি কোনো বাড়াবাড়ি নয়, বরং আইনের প্রতি তার অটল দায়বদ্ধতারই প্রতিফলন।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ইসরায়েল আছে, ফিলিস্তিন আছে। কোনো দেশ ৩০০০ বছর আগের দাবিতে অন্য দেশকে ধ্বংস করার অধিকার রাখে না। যদি কেউ আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে এবং প্রতিবেশীদের অধিকার রক্ষা করে, আমি তাদের পাশে থাকব। অন্যথায়, পারব না।” তার এই সাহসী বক্তব্য শুধু আমেরিকান মুসলিমদের জন্য নয়, ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো সকলের জন্য এক গর্বের বিষয়।
নতুন আমেরিকার সূচনা
লন্ডন, বার্মিংহ্যাম, ম্যানচেস্টারের মতো বিশ্বের অন্যান্য শহরে ইতোমধ্যেই মুসলিম মেয়ররা সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এবার নিউইয়র্কও সেই তালিকায় যুক্ত হলো। জোহরান মামদানির এই বিজয় একটি নতুন আমেরিকার সূচনা, যেখানে মানুষের আশা জাগে, দ্বেষ কমে এবং বৈচিত্র্যের মাঝে একতা গড়ে ওঠে।
তিনি এখন শুধু একজন মেয়র নন, তিনি একটি আন্দোলন, নতুন নিউইয়র্কের প্রতীক এবং সম্ভাবনাময় এক যুক্তরাষ্ট্রের শুরু।