নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
বৈষম্য বৃদ্ধি ও দুর্বল কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যসীমার নিচে ৩ কোটি, ঝুঁকিতে আরও ৬ কোটি।একসময় দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী অগ্রগতি দেখা গেলেও বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির যে গল্প শোনা যায়, দারিদ্র্য হ্রাসের গতি তার তুলনায় এখন অনেক বেশি ধীর। উদ্বেগের বিষয় হলো, বিগত চার বছর ধরে দেশে দারিদ্র্যের হার ক্রমশ বাড়ছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এর সুফল সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের কাছে খুব কম পৌঁছাচ্ছে। বরং বৈষম্য আরও গভীর হচ্ছে এবং লাখো পরিবারের জীবিকা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতি শক্তিশালী ছিল এবং এই সময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগব্যয়ও দ্রুত বাড়ছিল। তবে ২০১৬ সালের পর প্রবৃদ্ধির কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে, যেখানে উচ্চ আয়ের পরিবারগুলো বেশি লাভবান হয় এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর আয় থমকে যায়। ফলস্বরূপ, ২০১৬ থেকে ২০২২ সময়ে দারিদ্র্য হ্রাসের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
দারিদ্র্যের বর্তমান পরিস্থিতি
বর্তমানে দেশে ৩ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এর পাশাপাশি, জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৬ কোটি মানুষ যেকোনো বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুস্থতা বা বিপর্যয়ের কারণে পুনরায় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
দেশের প্রতি ১ শতাংশ জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধিতে দারিদ্র্য কমছে মাত্র $0.9\%$ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় ($1.5\%$) এর তুলনায় অনেক কম। এই পরিসংখ্যান এটাই নির্দেশ করে যে, প্রবৃদ্ধির গতি থাকলেও তা আর দারিদ্র্য মোকাবিলায় শক্তিশালী ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছে না।
বিশেষজ্ঞের মত
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ বলেন, “দারিদ্র্য কমার গতি যা ছিল, এখন আর তা নেই। এটাই সবচেয়ে বড় সতর্কতা। প্রবৃদ্ধিকে কাগজে দ্রুত দেখানো সহজ, কিন্তু তার সুফল দরিদ্র মানুষের আয়-ব্যয়ের বাস্তবতায় পৌঁছানোই আসল চ্যালেঞ্জ। বৈষম্য বাড়লে দারিদ্র্য স্থায়ী হয় এবং উন্নয়ন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জলবায়ু-সংক্রান্ত ঝুঁকি এবং শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ধীরগতি আগামী কয়েক বছরে দারিদ্র্য হ্রাসকে আরও কঠিন করে তুলবে। সরকারের নীতি এখন আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বিস্তৃত করা এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য সঠিক সুবিধাভোগীকে শনাক্ত করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।”
মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান ও সেবার মান
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দারিদ্র্য বৃদ্ধির মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
কর্মসংস্থান সংকট: পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া এবং চাকরি হারানোর ঘটনা বৃদ্ধি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি: খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে সরাসরি চাপ সৃষ্টি করছে। মজুরি সেভাবে বৃদ্ধি না পাওয়ায় এই চাপ আরও বাড়ছে।
কর্মসংস্থান হ্রাস: ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ কর্মসংস্থান কম হয়েছে এবং ২০২৫ সালে আরও ৮ লাখ কর্মসংস্থান কমার আশঙ্কা রয়েছে।
বিভিন্ন খাতে সরকারি ব্যয় ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিস্তৃত হলেও, সুবিধাভোগী শনাক্তকরণে দুর্বলতার কারণে প্রকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর একটি বড় অংশ কাঙ্ক্ষিত সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে, মৌলিক সেবা, যেমন-স্কুলে ভর্তি বাড়লেও শেখার মানের ঘাটতি এবং স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়লেও সেবার মান স্থবির থাকাও দারিদ্র্য কমার ধীর গতির পেছনে বড় বাধা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি
প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাস এবং আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে এবং কৃষি খাতে জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে।
দারিদ্র্য হ্রাসের গতি বাড়ানো এবং বৈষম্য কমিয়ে আনতে সরকারের কী কী জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?