নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা।
দৈনিক আজকের পত্রিকার সাবেক সম্পাদকীয় পাতার দায়িত্বপ্রাপ্ত, প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের রহস্যজনক মৃত্যুতে সাংবাদিক সমাজসহ দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। গত ২০ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধারের পর অভিযোগের আঙুল উঠেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলমের দিকে। একাধিক সূত্র এবং বিভুরঞ্জন সরকারের লেখা একটি খোলা চিঠি থেকে জানা যায়, মৃত্যুর আগে তিনি ক্রমাগত হুমকি ও মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। এই ঘটনাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
ঘটনার সূত্রপাত ও অভিযোগ
গত ১৪ আগস্ট দৈনিক আজকের পত্রিকায় সিপিবি নেতা মযহারুল ইসলাম বাবলার লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ইতিহাসের ঘটনাবহুল আগস্ট’। এই নিবন্ধটি প্রকাশের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম ক্ষুব্ধ হন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, নিবন্ধটিতে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত থাকায় তিনি পত্রিকাটির সম্পাদককে সরাসরি ফোন করে তীব্র ভাষায় হুমকি দেন। একই সঙ্গে, তিনি পত্রিকার লাইসেন্স বাতিল এবং গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে হয়রানির হুমকি দেন। তিনি আটজন সাংবাদিককে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা দিয়ে তাদের অবিলম্বে চাকরিচ্যুত করার জন্য চাপ দেন।
চাপের মুখে ছুটি ও মানসিক যন্ত্রণা
শফিকুল আলমের চাপের মুখে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠাতে বাধ্য হয় এবং অনলাইন সংস্করণ থেকে নিবন্ধটি দ্রুত সরিয়ে ফেলে। বিভুরঞ্জন সরকারের একজন সহকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিভু দা ছিলেন একজন আপাদমস্তক পেশাদার সাংবাদিক। তিনি শেষ দিনগুলোতে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। যেভাবে তাকে অপমান করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।” তার সহকর্মীরা মনে করেন, এটি নিছক একটি মৃত্যু নয়, বরং একটি ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড।
প্রয়াত সাংবাদিক তার খোলা চিঠিতেও এই মানসিক চাপের কথা উল্লেখ করে গেছেন। সেখানে তিনি লেখেন, ছুটিতে পাঠানোর পরও তাকে ফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল এবং তিনি এই বিষয়ে সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এর কয়েক দিন পরই মেঘনা নদী থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়, যা এই রহস্যকে আরও ঘনীভূত করেছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ক্ষোভ
এই ঘটনায় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। একজন জ্যেষ্ঠ কলামিস্ট এই ঘটনাকে ‘স্বাধীন সাংবাদিকতার কফিনে শেষ পেরেক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “যদি একটি নিবন্ধ প্রকাশের জন্য একজন প্রবীণ সাংবাদিককে জীবন দিতে হয়, তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আজ বিভুরঞ্জন গেছেন, কাল আমাদের পালা আসবে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।”
একইভাবে, একজন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী বিভুরঞ্জন সরকারের ঘটনাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চলমান আক্রমণের একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “যখন গণমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়, তখন পুরো সমাজই অনিরাপদ হয়ে পড়ে। আমরা অবিলম্বে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি।”
এদিকে, সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো এই নৃশংস ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তারা এই মৃত্যুর পেছনে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। প্রয়াত সাংবাদিকের ছেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার বাবা কোনো অন্যায় করেননি। যারা তাকে ফোনে হুমকি দিয়েছে এবং চাকরি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছে, তারাই আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আমরা আর কিছু চাই না, শুধু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।” তিনি প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করার আকুল আবেদন জানান।