অনলাইন ডেস্ক ॥
ঢাকা: রাজধানীর হাতিরঝিলে বিয়াম ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারির অগ্নিকাণ্ড কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্নীতি-সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার উদ্দেশ্যেই এই আগুন লাগানো হয়েছিল। মর্মান্তিকভাবে, আগুন লাগানোর সময় একটি আকস্মিক বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই আব্দুল মালেক নামের একজন নিহত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফারুক নামের আরেকজন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিসিটিভি ফুটেজ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিশ্লেষণের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য উদ্ঘাটন করেছে।
সোমবার (২৮ জুলাই, ২০২৫) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর কল্যাণপুরে পিবিআইয়ের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন (এসআইঅ্যান্ডও) ইউনিটের (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের বিশেষায়িত এই ইউনিটের পুলিশ সুপার মো. আবদুর রহমান। এ সময় এসআইঅ্যান্ডও (উত্তর) এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থোয়াইঅংপ্রু মারমা উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনার সূত্রপাত ও তদন্তের অগ্রযাত্রা
সংবাদ সম্মেলনে আবদুর রহমান জানান, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টা ২০ মিনিটের দিকে বিয়াম ফাউন্ডেশনের ৫০৪ নম্বর কক্ষে বিস্ফোরণ ঘটে। কক্ষটিতে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির অফিস ছিল। বিস্ফোরণে সমিতির নানা গুরুত্বপূর্ণ নথি (দলিল, নামজারির কাগজ, জমি কেনার চুক্তিপত্র), ব্যাংক হিসাবের চেকবই, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, আসবাবপত্র এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) পুড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান অফিস সহায়ক আব্দুল মালেক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সমিতির সাধারণ সম্পাদকের গাড়িচালক মো. ফারুকের মৃত্যু হয়।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ এই ঘটনাকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা বলে ধারণা করেছিল। তবে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক, অবসরপ্রাপ্ত সচিব মশিউর রহমান, হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআইয়ের বিশেষায়িত ইউনিট এবং প্রায় দুই মাসের নিবিড় তদন্ত শেষে তারা ঘটনার বিস্তারিত তথ্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়।
সিসিটিভি ও এআই-এর মাধ্যমে রহস্য উন্মোচন
পিবিআই এই ঘটনার ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ফুটেজ নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে। ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার রাতে মাস্কিংক্যাপ, মাস্ক, গ্লাভস এবং স্যান্ডেল পরা অবস্থায় একজন ব্যক্তি বিয়াম ভবনের পাঁচতলার ঘটনাস্থলে যান এবং সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। পিবিআই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে এই ব্যক্তিকে শনাক্ত করে। তার নাম আশরাফুল ইসলাম। তাকে কুড়িগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আশরাফুলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ঘটনার বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দুর্নীতির নথি পোড়ানোর সুপরিকল্পিত ছক
আবদুর রহমান জানান, জাহিদুল ও আশরাফুল পূর্বপরিচিত এবং তাদের দুজনেরই বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। ঘটনার কয়েক মাস আগে জাহিদুল, আশরাফুলকে কুড়িগ্রাম থেকে এনে রাজধানীর একটি তিন তারকা হোটেলে রাখেন। সমিতির নথিপত্র ধ্বংস করার জন্য জাহিদুল আসামি আশরাফুল, অফিস সহায়ক আবদুল মালেক এবং গাড়িচালক ফারুকের সঙ্গে মিলে একটি পরিকল্পনা করেন। কাজ সফল হলে তাদের ১০-১২ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন রাতে আশরাফুল পাঁচতলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করেন। এরপর মালেক ও ফারুক ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। আশরাফুল তখন কক্ষের দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। কক্ষে প্রবেশ করে মালেক ও ফারুক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এর আগেই আশরাফুল সিঁড়ি দিয়ে তৃতীয় তলায় নেমে যান। আশরাফুল তৃতীয় তলায় নামতেই কক্ষটিতে বিকট বিস্ফোরণ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মালেক মারা যান এবং ফারুকের শরীর আগুনে পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে আশরাফুল ভবন থেকে পালিয়ে হোটেলে ফিরে যান। পরে জাহিদুল ঘটনাস্থলে এসে আশরাফুলের সহযোগিতায় ফারুককে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে ভর্তি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফারুক মারা যান।
তদন্তের পরবর্তী ধাপ
পিবিআই জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী শুধু সমিতির নথিপত্র পোড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু পেট্রল দিয়ে আগুন দেওয়ার সময় যে বিস্ফোরণ ঘটবে, তা তারা বুঝতে পারেননি। যার কারণে এই ঘটনায় জড়িত মালেক ও ফারুক আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। পুড়ে যাওয়া নথিপত্রে কী ধরনের তথ্য ছিল, তা এখনো জানা যায়নি। পিবিআই মামলার প্রথম ধাপ শেষ করেছে। দ্বিতীয় ধাপে তারা পুড়ে যাওয়া নথিপত্রে কী তথ্য ছিল, তা নিয়ে কাজ করবে। একই সঙ্গে এই ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কি না, সে বিষয়েও তদন্ত চলবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে আসামি শনাক্তের বিষয়ে আবদুর রহমান বলেন, “প্রথমে আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি। একটি কক্ষের ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হলেও বাকিগুলো চালু ছিল। সেখান থেকে আমরা আশরাফুলের মাস্ক পরা ছবি পাই। পরে এআই-এর সহযোগিতায় আশরাফুলকে শনাক্ত করি। আশরাফুলের ওই অফিসে আসা-যাওয়া ছিল, সেই ছবি দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়।”
এই ঘটনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তদন্তের পরবর্তী ধাপে আরও কী চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে, তা জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।