প্রেস বিজ্ঞপ্তি ॥
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ‘অডিট আপত্তি’র অপপ্রচারকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট মো. মনিরুজ্জামান মনির।
২৪ জুলাই বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের ইতিহাসে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এক অনন্য মাইলফলক। এটি কেবল একটি রেললাইন নয়—এটি একটি অর্থনৈতিক করিডোর, একটি উন্নয়নের ধারা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন। প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্প দেশের অন্যতম বৃহৎ ও জটিল প্রকৌশল প্রকল্প। এর সফল বাস্তবায়ন দেশবাসীকে এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে।
কিন্তু যে সময়টিতে প্রকল্পটি তার সাফল্যের শিখরে, তখনই কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এবং একটি বিশেষ অংশ সংবাদমাধ্যমের অপব্যবহার করে প্রকল্পের ব্যয়কে কেন্দ্র করে “১৩ হাজার কোটি টাকার অডিট আপত্তি” শিরোনামে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এ অপপ্রচার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তথ্য বিকৃত এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এক বিপজ্জনক নজির।
প্রকল্প ব্যয় ও তথাকথিত ‘অডিট আপত্তি’: বিশ্লেষণ-
সাম্প্রতিকভাবে যে অডিট আপত্তির কথা সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে, তা মূলত ৪২টি খাত ও ৭টি অতিরিক্ত ব্যয়ের পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত খাতে অর্থব্যয় হয়েছে। মূল আপত্তির বিষয়গুলো হলো:
* ভূমি অধিগ্রহণে অনুমোদনের তুলনায় ব্যয়বৃদ্ধি
* ভূগর্ভস্থ মাটি ও নদীপ্রবাহ বিশ্লেষণে ব্যয়
* অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ (এজিএল)
* কোভিড-১৯ পরিস্থিতিজনিত খরচ
* সফটওয়্যার ও রিপোর্টিং খাতে অর্থ বরাদ্দ
* প্রোভিশনিং বা ‘প্রোভিশনাল সাম’ খাতে অর্থ সংরক্ষণ
* তথাকথিত “গ্যাপ ভাতা” বিষয়ক মন্তব্য
প্রথমত, এগুলোর প্রায় সবকটিই পূর্বপরিকল্পিত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গৃহীত এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের বাস্তব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।
প্রকৌশল বাস্তবতা ও অডিট আপত্তির বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদ:
১. আন্তর্জাতিকমানের প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় স্বাভাবিক
এই প্রকল্পে ভূমিকম্প সহনশীল রেললাইন, হাইড্রোলজিক্যাল ও টেকনিক্যাল পরীক্ষাসমূহ, নদীশাসন, টানেলিং, একাধিক স্টেশন নির্মাণ, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং জটিল কারিগরি সংযোজন রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতেও এমন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় খুব স্বাভাবিক, বিশেষত যেখানে প্রকল্পটি নদী ও সমতলভূমির মাঝামাঝি ভূপ্রকৃতিতে অবস্থিত।
২. অতিরিক্ত জমি (এজিএল) প্রকল্প রক্ষায় অপরিহার্য
অতিরিক্ত গ্র্যান্ড অফ ল্যান্ড (এজিএল) প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনার অংশ। ভবিষ্যতে রেললাইন সম্প্রসারণ, নিরাপত্তা বাফার, সাইডিং রেল, সিগনালিং ব্যবস্থা, সাবস্টেশন ইত্যাদির জন্য ভূমি প্রয়োজন হয়। এই জমি অধিগ্রহণকে “অতিরিক্ত ব্যয়” হিসেবে দেখানো প্রকৌশল অজ্ঞতার পরিচায়ক।
৩. কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যয়—ব্যর্থতা নয়, সাফল্যের প্রতীক
বিশ্ব যখন লকডাউনে স্থবির, বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই প্রকল্প চালু রেখেছে। এতে ব্যয় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও, কাজ বন্ধ না হওয়ার ফলে ভবিষ্যতের বড় ক্ষতি থেকে দেশ বেঁচে গেছে। সুরক্ষা সামগ্রী, শ্রমিকের আবাসন, চিকিৎসা সহায়তা, পরিবহন ইত্যাদি খাতে ব্যয় সাফল্যের গৌরব।
৪. তথ্য ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় আধুনিক প্রকল্প ব্যবস্থাপনার অংশ
ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ডিএমএস), রিপোর্টিং সফটওয়্যার, ক্লাউড সার্ভার, প্রকল্প পর্যবেক্ষণ সফটওয়্যার—সবকিছু একটি আন্তর্জাতিকমানের প্রকল্পে অপরিহার্য। এসব ব্যয়কে অপ্রয়োজনীয় বলা মানে অজ্ঞতা অথবা বিভ্রান্তি সৃষ্টি।
৫. প্রোভিশনিং ব্যয় আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ ও নীতিনির্ধারিত
বিশ্বব্যাপী বড় প্রকল্পে অনিশ্চিত খরচ মোকাবিলায় ‘প্রোভিশনিং’ খাতে একটি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। এটি দুর্নীতি নয়, বরং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা।
সংবাদমাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার: রাষ্ট্রবিরোধী প্রবণতা:
সম্প্রতি কিছু সংবাদমাধ্যম ও অনলাইন পোর্টাল অপপ্রচার চালাচ্ছে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকেই গুজব ছড়াচ্ছে। যেভাবে শিরোনামে “১৩ হাজার কোটি দুর্নীতি!” বলে চিত্রায়ন করা হচ্ছে, তাতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মনোবল চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
*মিথ্যা শিরোনাম দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে
*প্রকৌশলী, শ্রমিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ত্যাগ প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে
*দেশের অর্জনকে দুর্নীতির চাদরে ঢেকে জাতীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে
এটি কেবল একটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে অপপ্রচার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অর্জনের বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত মিডিয়া ষড়যন্ত্র।
রেলওয়ে পোষ্যদের অবস্থান ও জনমত গঠনের ডাক:
বাংলাদেশ রেলওয়ের হাজারো পোষ্য পরিবার, যারা তাদের পূর্বপুরুষদের রক্ত-ঘামে নির্মিত এই রেলপথের উত্তরাধিকার বহন করছেন, তারা এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। আমাদের সন্তানেরা এই উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে, সে সম্ভাবনাকে ধ্বংসের চক্রান্তে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না।
আমরা আহ্বান জানাই—
প্রকল্পে যুক্ত প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে জাতীয় পর্যায়ে সংহতি গড়ে তুলুন, অপপ্রচারে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচার নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করুন, প্রকল্প ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ জনসমক্ষে উপস্থাপন করুন। মিথ্যা সংবাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিন।
মনিরুজ্জামান মনির বলেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প কেবল একটি রেলপথ নয়—এটি বাংলাদেশের সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও উন্নয়নের প্রতীক। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো মানেই দেশের প্রবৃদ্ধি, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং গণমানুষের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষাকে দমন করা। আমরা এই প্রেক্ষাপটে রেলওয়ের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, শ্রমিক এবং দেশের সচেতন নাগরিকদের এক কণ্ঠে বলি: “আমরা ষড়যন্ত্র রুখবো, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন রক্ষা করবো।”