মনিরুজ্জামান মনির ॥
দৃষ্টিনন্দন, ঝকঝকে-তকতকে এক আপেল। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এর গভীরতর ক্ষয়ের গল্প। কিন্তু যখন সেই আপেলটি ছুরি দিয়ে কাটা হয়, তখনই প্রকট হয়ে ওঠে এর নির্মম সত্য—ভিতরে একেবারে পচে গেছে, খাওয়া তো দূরের কথা, নাকে পর্যন্ত নেওয়া যায় না।
এই একখানা আপেলের গল্প যেন হুবহু মিলে যায় আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর চেহারা ও প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের নৈতিক দৈন্যের সঙ্গে। বাইরে থেকে পরিষ্কার, উন্নয়নের ফটোগ্রাফি, প্রটোকল ও মোড়কে মোড়ানো নেতৃত্ব—কিন্তু ভিতরে আছে পচন, দুর্নীতি, বেইমানি আর দেশপ্রেমের তীব্র অভাব।
চকচকে চামড়ার পেছনে গন্ধ: রাজনীতির আপেল:
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল অর্থ শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার পন্থা নির্ধারণ নয়, বরং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের দায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল আজ বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড, ডিজিটাল প্রচার—সবই চোখধাঁধানো। কিন্তু আদতে তা একপ্রকার “কাজ নেই বলার মতো কাজ দেখানো” রীতির প্রতিফলন।
একটি আপেলের যেমন বাহিরে কোনো দাগ নেই অথচ ভেতরে রয়েছে পচন ধরা, তেমনি এইসব দলের নেতাদের মুখে শুদ্ধতা ও আদর্শের বুলি শোনা গেলেও কার্যক্ষেত্রে রয়েছে লুটপাট, চাটুকারিতা, স্বজনপ্রীতি ও জাতীয় স্বার্থ বিক্রির নীলনকশা।
সরকারের আমলারা: আপেলের কিটে ধরা বীজ?
রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার হলো সরকারি প্রশাসন। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে রয়েছে এক অদ্ভুত দ্বৈততা। রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন ক্ষমতার লালসায় অন্ধ হয়ে গেছেন। তারা জনগণের সেবা না করে আজ রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত উপকারে নিয়োজিত ‘পেট আমলা’তে পরিণত হয়েছেন।
ঠিক যেভাবে আপেলের বীজ কিডে ধরা থাকলে পুরো ফলটিই ধ্বংস হয়ে যায়, তেমনি আমলাতন্ত্রে নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাই দুর্নীতির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আজ আমরা সেই পথেই হাঁটছি।
গণতন্ত্রের বদলে প্রহসনের মোড়ক:
আলোচিত ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি এখন শুধুই ব্যবহারের বস্তু। নির্বাচনের নামে প্রহসন, বিরোধী মতকে দমন, বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার—সবই গণতন্ত্রের নামে গলা টিপে ধরা। জনগণের ভোটাধিকার বা অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই বললেই চলে।
একটি আপেল যদি বাইরে থেকে সম্পূর্ণ মনে হয়, অথচ কাটার পর দেখা যায় পোকা খেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে—তবে সেই আপেল আর খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য থাকে না। তেমনি একটি রাষ্ট্র যদি গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র বা প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদ চালায়, তবে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা নাগরিকের জন্য কল্যাণকর নয়, বরং ধ্বংসাত্মক।
উন্নয়নের মুখোশ:
আজকাল একটি জনপ্রিয় শব্দ হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। কিন্তু উন্নয়ন কার জন্য? কোথায়? কীভাবে? এই প্রশ্নগুলো অপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রাস্তা, ব্রিজ, ভবন নির্মাণের প্রকল্প থাকলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও পরিবেশের দিকে নজর নেই। বাস্তবে এই তথাকথিত উন্নয়ন যেন একটি পচা আপেলের মুখে চকচকে পালিশ লাগানোর মতো।
আবারও বলি, আপেলের বাহিরে চকচকে অংশ যদি এক ধরনের ধোঁকা হয়, তাহলে বাংলাদেশের তথাকথিত মেগা প্রকল্পগুলো অনেকাংশে সেই ধোঁকার প্রতীক। মানুষ যে প্রশ্ন তোলে না, তার উত্তরও খুঁজে পাওয়া যায় না। এটাই উদ্দেশ্য, এটাই নান্দনিকতার ছদ্মবেশে দুর্নীতির বিস্তার।
প্রশাসনিক নির্লজ্জতা ও মানবিকতার অবক্ষয়:
এক সময় ছিল, সরকারি কর্মচারী মানেই জনগণের সেবক। আজ তা উল্টো চিত্র—প্রভু ও সেবকের পার্থক্য ঘুঁচে গিয়ে জনগণ যেন প্রশাসনের করুণা প্রার্থী। পদ-পদবির জন্য দালালি, বদলির জন্য টাকা, পদোন্নতির জন্য তদবির—সবই আজ প্রশাসনিক বাস্তবতা।
পচা আপেল যেমন খাবার উপযোগী থাকে না, তেমনি এইসব নীতিহীন আমলারা রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়। তারা যখন পচে যায়, তখন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রে সংক্রমণ ঘটে।
যুবসমাজ: ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নাকি হতাশার প্রতিচ্ছবি?
আজকের তরুণরা রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করতে চায়, কিন্তু আদর্শ নিয়ে নয়—ক্ষমতা ও সুবিধার আশায়। কারণ তারা দেখছে, ত্যাগে নয়, সুবিধাবাদীতার ভিত্তিতে নেতা হওয়া যায়। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও একধরনের ‘আভ্যন্তরীণ পচন’ শুরু হয়েছে।
আমরা যদি এই সমাজ কাঠামোকে আরেকটি আপেল ধরে নিই, তবে আমাদের সন্তানেরা হচ্ছে সেই আপেলের ভেতরের অংশ। আজ যেভাবে তারা হতাশ, নিপীড়িত, বিভ্রান্ত—তা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়ংকর ইঙ্গিত।
আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: নিরপেক্ষতা না দলীয়তার প্রতিচ্ছবি?
আজ যে বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক ছায়ায় চলে, তা কারও অজানা নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা-মোকদ্দমা, জামিনের হেরফের, রায় বিলম্ব—সবই এক ধরনের ‘ন্যায়বিচারের পতন’। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা হারিয়ে একপক্ষের পাহারাদার হয়ে উঠেছে।
ঠিক যেমন পচা আপেলের মধ্যে একাংশ হয়তো কিছুটা ভালো থাকে, কিন্তু পুরোটা খাওয়া যায় না—তেমনি কিছু সৎ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও গোটা বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছে জনগণ।
মিডিয়া: আপেলের পালিশ না আয়নার প্রতিচ্ছবি?
মিডিয়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু বর্তমান মিডিয়ার একাংশ যেন সরকারের ‘চকচকে আপেল’ মোড়ক বজায় রাখার কাজেই নিয়োজিত। সত্য প্রকাশের বদলে সরকারপন্থী বয়ান প্রচার, বিরোধীদের গলা টিপে ধরা, আর বিজ্ঞাপনের মোহে নীতির বিসর্জন—এসব আজ নিত্যচিত্র।
যে সাংবাদিকরা আপেলের ভেতরের পচন তুলে ধরতে চান, তাদের জন্য রয়েছে মামলা, হুমকি ও চাকরি হারানোর ভয়। ফলে মিডিয়ার স্বাধীনতা বলতে এখন শুধু সুশ্রী একটি লেবেল—মতপ্রকাশের বাস্তব সুযোগ নেই।
করণীয়: পচা অংশ ছেঁটে ফেলা না পুরো কাঠামোর পরিবর্তন?
একটি পচা আপেল থেকে কেবল পচা অংশ বাদ দিয়ে ভালো অংশ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়, যদি পচনটা কেন্দ্রে চলে যায়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থা এখন ঠিক সেই জায়গায় পৌঁছেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন:
1. নির্বাচন ব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কার
2. দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন গঠন
3. জবাবদিহিমূলক আমলাতন্ত্র
4. বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত
5. জনগণের অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ননীতি
6. মিডিয়ার সত্য প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা
7. তরুণ সমাজকে মূল্যবোধ নির্ভর নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত করা
আপেলটি বদলাও, নয়তো পচা ফলেই জাতি ধ্বংস হবে:
বাংলাদেশ এখন এক আপেলের মতোই: বাইরে চকচকে, ভিতরে পচা। আমরা যদি শুধু বাইরের চাকচিক্যে মুগ্ধ থাকি এবং ভেতরের পচনের বিরুদ্ধে না দাঁড়াই, তাহলে গোটা রাষ্ট্র একসময় জনবিশ্বাস হারাবে। তখন আর সময় থাকবে না সংশোধনের।
আমাদের দরকার সত্য বলার সাহস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, এবং রাজনীতিকে জনগণের সেবায় ফিরিয়ে আনার শুদ্ধ প্রচেষ্টা। নয়তো রাষ্ট্র নামক আপেলটি একদিন সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাবে—যা কেবল ইতিহাসে একটি ব্যর্থ জাতি হিসেবেই আমাদের ঠাঁই দেবে।