নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তার মতে, গত এক বছরে সরকারের কার্যক্রমের ‘পাওনার হিসাব’ ও ‘উত্তরণের পথরেখা’ নির্ধারণ করা এখন অত্যন্ত জরুরি। বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচন—এই মৌলিক বিষয়গুলোতে এক বছরে কতটা অগ্রগতি হয়েছে, সে প্রশ্নই আজ মুখ্য।
বুধবার (২৩ জুলাই) কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে হোসেন জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন। বৈঠকের শুরুতে উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ফিরিয়ে আনার আহ্বান
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, মানুষ বর্তমানে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে এবং দর্শক হয়ে আছে। এত বড় একটি পরিবর্তনে তারা আর অংশগ্রহণকারী নয়। এই পরিস্থিতি থেকে মানুষকে আবার সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর পর্যায়ে ফিরিয়ে আনাই সরকারের মূল কাজ হওয়া উচিত। এর একটি মাধ্যম অবশ্যই নির্বাচন, তবে এর পাশাপাশি অন্য উপায়েও চিন্তা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের সক্ষমতায় যে ধস নেমেছে, তা নিয়ে ‘চিৎকার’ করা প্রয়োজন এবং যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের এই বিষয়টি শুনতে হবে। মানুষকে গণনার বাইরে রাখা যাবে না এবং ‘কাগুজে প্রক্রিয়ায়’ মেধা ও মনোযোগ আটকে রেখে জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।
‘বাংকার মেন্টালিটি’ ও জাতীয় ঐক্যের অভাব
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চার দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের ইঙ্গিত করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মনে হচ্ছে ‘বাংকার মেন্টালিটি’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই মানসিকতা তখন তৈরি হয় যখন সবকিছুকে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয় এবং মানুষকে সহযোগী হিসেবে না দেখে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তিনি সতর্ক করেন যে, পরাজিত সরকারের অনুশোচনাহীন সমর্থক গোষ্ঠীর অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা একটি বড় বিপদ, তবে ‘বাংকার মেন্টালিটি’ দিয়ে এর সমাধান সম্ভব নয়।
জিল্লুর রহমান দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া’ সরাসরি জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তার মতে, জুলাই-আগস্টের জাতীয় ঐক্যের শক্তি এখন পেছনের সারিতে চলে গেছে এবং ‘কেতাবি যোগ্যতার’ সমাহার থাকলেও প্রকৃত সক্ষমতার ব্যাপক ধস নেমেছে। মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারণ ও আলোচনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সক্ষমতার অভাব চোখে পড়ছে।
শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও বেকারত্বের ভয়াবহ চিত্র
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান দেশের বিভিন্ন খাতে চলমান সংকট তুলে ধরেন। তিনি শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা এবং বেকারত্বের পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে আখ্যায়িত করেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে এক ভয়াবহ বাস্তবতা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দৈনন্দিন বাস্তবতায় এর ভয়াবহতা স্পষ্ট। পুলিশ নিষ্ক্রিয় এবং মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড অস্থিরতা বিরাজ করছে। নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানে তরুণ নির্যাতনকারীর সংখ্যা বেশি হওয়া উদ্বেগের। বেকারত্বের ভয়াবহতা এতটাই যে, ঢাকা শহরে ইজিবাইক চালকদের মতো নতুন পেশাজীবীরাও কাজের সন্ধানে এসেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়তো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভিন্ন পথে এগোনোর চেষ্টা ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ‘নরমাল স্টেট ডাইনামিকস’ বুঝে গেছে যে বড় কিছু হবে না। ডিসেম্বরের পর থেকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি পূর্ণোদ্যমে আবার নিজেকে এসার্ট করেছে’ এবং ‘আমলা কর্তৃত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে জেঁকে বসেছে’। তিনি স্বীকার করেন যে, হাসিনার পলায়ন এবং পূর্ববর্তী সরকারের পতন একটি ‘আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ’ ঘটিয়েছিল, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রবলভাবে ফিরে এসেছে।
ন্যায়বিচার নয়, প্রতিশোধ স্পৃহা!
ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, যেখানে ‘ইনসাফ’ বা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল, সেখানে ‘প্রতিশোধকেই মাধ্যম হিসেবে নেওয়া হয়েছে’। লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে এই অমিল সমাজে প্রতিশোধ স্পৃহাকে বড় করে তুলেছে, যা ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বাধা দিচ্ছে।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের সঞ্চালনায় এই গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের গবেষণা বিশেষজ্ঞ সহুল আহমদ প্রমুখ।