বিশেষ প্রতিবেদক॥ ঢাকা: জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ৪৭৩টি প্লটসহ মিরপুরে প্রায় ৭০০ একর সরকারি জমি দখল এবং বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ঢাকা-১৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই অনুসন্ধানে নেমে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম।
দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে, ইলিয়াস মোল্লাহর নিজের ও পরিবারের নামে আয়াজ প্যালেস, শ্যামপুর, বিরুলিয়া ও সাভারে কয়েকশ বিঘা সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে বিরুলিয়ায় ৬০ বিঘার ওপর একটি বাগান বাড়ি এবং একই জায়গায় তার ছেলের নামে একটি আলাদা বাংলো বাড়ি রয়েছে। এছাড়া ইলিয়াসের নিজের নামে তিনটি ব্যক্তিগত গাড়ির তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ৪৭৩টি প্লট ও প্রায় ২৬ একর জমি, মিরপুর-১ নম্বরে জাতীয় চিড়িয়াখানার নামে বরাদ্দ হওয়া প্রায় দুই একর জমি এবং মিরপুর-২ নম্বরে তুরাগ নদের অংশ ভরাট করে দুই শতাধিক বস্তিঘর গড়ে তোলার অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। তবে, এসব অভিযোগের দালিলিক নথিপত্র সংগ্রহ করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে দুদক।
দুদকের তলব ও সতর্কবার্তা
অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে অনুসন্ধান টিম ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহকে আগামী ৯ জুলাই বেলা ১১টায় বেশকিছু নথিপত্রসহ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে চিঠি দিয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক মো. মোজাম্মিল হোসেন স্বাক্ষরিত তলবি নোটিশে ইলিয়াস মোল্লাহকে যেসব দলিলপত্র সঙ্গে আনতে বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: নিজ এবং পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিস্তারিত বিবরণ, ব্যাংক হিসাবের বিবরণী, বিগত পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্নের কপি, যানবাহনের মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদ ও জন্ম নিবন্ধনের কপি, পাসপোর্টের কপি এবং ব্যবসা/শেয়ার/বিনিয়োগ সংক্রান্ত দলিল।
যদিও দুদকসহ বিভিন্ন সূত্র বলছে, ইলিয়াস মোল্লাহ বর্তমানে পলাতক অথবা বিদেশে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা বলেন, “অনুসন্ধানের স্বার্থে অনুসন্ধান কর্মকর্তা যেকোনো নথিপত্র এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণের জন্য তলব করতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব এখতিয়ার। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি সহযোগিতা না করেন বা বক্তব্য না দেন, তাহলে তিনি তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন। কমিশন অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”
উপপরিচালক মো. মোজাম্মিল হোসেনের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত দুদকের অনুসন্ধান টিমের অপর সদস্যরা হলেন: সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম ও ফেরদৌস রহমান।
অবৈধ সম্পদের বিস্তর অভিযোগ
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র চেয়ে ব্যাংক, বীমা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, তিতাস গ্যাস, ঢাকা ওয়াসাসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে চিঠি দেয় অনুসন্ধান টিম। চিঠিতে ইলিয়াস মোল্লাহর স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ও চার সন্তানের নামে-বেনামে থাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, গণপূর্ত কাজে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মিরপুরে ৭০০ একর সরকারি জমি দখলসহ নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অনুসন্ধানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। তলব করা নথিপত্রের কিছু কিছু ইতোমধ্যে দুদকে এসেছে বলে জানা গেছে।
দুদকের অনুসন্ধানে ইলিয়াস মোল্লাহর নিজ ও পরিবারের নামে সাভারে আয়াজ প্যালেস, শ্যামপুর, বিরুলিয়া ও সাভারে কয়েকশত বিঘা সম্পদের খোঁজ মিলেছে। যার মধ্যে রয়েছে বিরুলিয়ায় ৬০ বিঘা জায়গার ওপর বাগান বাড়ি ও ছেলের নামে পৃথক একটি বাংলো বাড়ির তথ্য-প্রমাণ।
হলফনামা ও আয়করের তথ্য বনাম বাস্তব চিত্র
ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থসহ মোট ৬ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার ৬০০ টাকা আয়কর নথিতে দেখিয়েছেন। রিটার্নে মোট তিনটি গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তার হলফনামায় মোট বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ৭৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের হলফনামায় তার আয় দেখানো হয় ৩ কোটি ১১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে ব্যবসা হিসেবে মাছ চাষ দেখানো হয়েছিল। এরপর দেখানো হয় একটি অ্যাগ্রো ফার্ম, একটি মৎস্য খামার ও একটি বিপণিবিতান। এছাড়া দেখানো হয় দুটি বাড়ি ও একটি অ্যাপার্টমেন্ট। ইলিয়াস মোল্লাহর নামে ৬০ ভরি ও স্ত্রীর নামে ৩২ ভরি সোনা দেখানো হয়েছে।
তবে, স্থানীয়রা এ সম্পদের হিসাবকে হাস্যকর উল্লেখ করে বলেছেন, তার এ সম্পদের তুলনায় কয়েকশ গুণ বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
দুয়ারীপাড়ার প্লট দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ইলিয়াস মোল্লাহর আয়ের বড় একটি উৎস হলো দুয়ারীপাড়া। ১৯৮১ সালে মিরপুর সাড়ে ১১ সংলগ্ন দুয়ারীপাড়ার ৪৭৩টি প্লট জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সরকারি কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ দেয়। এসব প্লটের আয়তন পৌনে দুই, আড়াই ও তিন কাঠা। ওই জমি ওয়াক্ফ এস্টেটের বলে দাবি করলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইলিয়াস মোল্লাহ ওই জমি দখল করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে এসব জমি নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। জমি থেকে উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে বছরে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া হতো। এছাড়া সেখানে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিয়ে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে প্রতি মাসে বিল বাবদ ও ভাড়ার নামে টাকা তুলতেন তিনি।
অভিযোগে বলা হয়, ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে ওই জায়গায় ৪৭৩টি প্লট ছিল। এসব প্লটে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা ছিল সাত হাজারের বেশি। যত প্লট বাড়ানো হবে তত টাকা এ ধারণায় ৪৭৩টি প্লটকে ভেঙে সাত শতাধিক প্লট বানানো হয়। প্লটগুলো যাদের দখলে ছিল তারা ইলিয়াস মোল্লাহর কাছে জিম্মি ছিলেন। এসব প্লট থেকে চারবার উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে প্রতিবারই প্লট প্রতি দুই থেকে চার লাখ করে মোট অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ইলিয়াস মোল্লাহ। এছাড়া এলাকার মার্কেট, ছোট দোকান, ফুটপাতের দোকান থেকেও তার অনুগতরা নিয়মিত টাকা তুলতেন। সেই টাকা সরকারি তহবিলে জমা দেওয়া হতো না। ২০০৮ সালে দুয়ারীপাড়ায় সরকারি প্লট থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়। পরের বছর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ইলিয়াস মোল্লাহর বাহিনী তা পুনরায় দখল করে নেয়। দখল পাকাপোক্ত করতে তারা একই বিষয়ে পাঁচ-ছয়বার মামলা করে। কিন্তু প্রতিবারই আদালত সরকারের পক্ষে রায় দেয়।
অন্যান্য সরকারি জমি ও বস্তি দখলের অভিযোগ
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ৪৭৩টি প্লট ও প্রায় ২৬ একর জমি, মিরপুর-১ নম্বরে জাতীয় চিড়িয়াখানার নামে বরাদ্দ হওয়া প্রায় দুই একর জমি এবং মিরপুর-২ নম্বরে তুরাগ নদের অংশ ভরাট করে দুই শতাধিক বস্তিঘর গড়ে তোলার অভিযোগেরও সত্যতা মিলেছে।
এছাড়াও মিরপুর-১২ নম্বরের মোল্লার মার্কেট সংলগ্ন ইলিয়াস মোল্লাহর বাড়ির পেছনের অংশে একসময় তুরাগ নদের কিছু অংশ ভরাট করে বস্তি তৈরি করা হয়। স্থানীয়রা এটিকে ‘ইলিয়াস মোল্লাহর বস্তি’ হিসেবে চেনে। সেখানে দুই শতাধিক ঘর রয়েছে। ঘরগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, মিরপুর-১ নম্বরের উত্তর বিশিল মৌজায় গুদারাঘাটের লাল মাঠ এলাকায় জাতীয় চিড়িয়াখানার কর্মচারীদের কোয়ার্টারের জন্য প্রায় দুই একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই জমিও ইলিয়াস মোল্লাহর সমর্থকদের দখলে রয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, রূপনগর, দুয়ারীপাড়া, মিরপুর-১০, পলাশনগর, মানিকদি, ইস্টার্ন হাউজিং, আরামবাগ, মিরপুর-৬, ৭ ও বাউনিয়ার সব পাড়া-মহল্লার ফুটপাত ও রাস্তার ওপর বসানো অস্থায়ী দোকানের ভাড়া ইলিয়াস মোল্লাহর অনুগতদের দিতে হতো। প্রতিটি অস্থায়ী দোকান থেকে দৈনিক ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো। এসব কাজে পাড়া-মহল্লায় ছয় থেকে সাতজনের গ্রুপ কাজ করত। রূপনগর টিনশেড কলোনি নামে পরিচিত এলাকাটিও ছিল ইলিয়াস মোল্লাহর আয়ের আরেক উৎস।
রাজনৈতিক পরিচয়
ইলিয়াস মোল্লাহর পৈতৃক বাড়ি পল্লবীর হারুনাবাদ এলাকায়। তার বাবা হারুন আল রশীদ মোল্লাহ পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইলিয়াস মোল্লাহ ২০০৫ সালের দিকে পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। তিনি পল্লবী এলাকায় মাছের ঘেরের ব্যবসা করতেন। আসন পুনর্বিন্যাস হলে তিনি ঢাকা-১৬ আসনে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন।