অনলাইন ডেস্ক॥
করোনার করাল গ্রাসে যখন দেশজুড়ে মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত, তখন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি স্তরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
কপাল খুলে গেল ‘টাকার কুমির’ জাহিদ মালেকের
শেখ হাসিনার আশীর্বাদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার পর জাহিদ মালেকের কপাল খুলে যায়। করোনাকালে যখন দেশের মানুষ আয়হীন-কর্মহীন এবং সেবা ও শিল্প খাত যখন মারাত্মক ক্ষতির মুখে, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক হয়ে ওঠেন ‘টাকার কুমির’। করোনার টিকা বাণিজ্য, টেস্ট কিট সরবরাহ, নকল মাস্কের ভুয়া আমদানি, হাসপাতালের কেনাকাটা, ওষুধ ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহ, এমনকি অবকাঠামো উন্নয়ন কাজেও বেপরোয়া অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
অবৈধ সম্পদের পাহাড় ও বিদেশে অর্থ পাচার
জমি দখল, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন খাত এবং নিয়োগ বাণিজ্যেও জাহিদ মালেক মন্ত্রিত্বকে টাকা বানানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি তাঁর অবৈধ অর্থের বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করেছেন। বৈধভাবে ৬৮ কোটি টাকা থেকে রাতারাতি তিনি ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকার মালিক বনে যান। এর মধ্যে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বর্তমানে জাহিদ মালেকের এই বিপুল সম্পদের উৎস খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। দুদক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে বিদেশে ১ হাজার কোটি টাকা পাচার এবং দেশে ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এসব অবৈধ সম্পদের বেশিরভাগই তিনি নিজের নামে এবং আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে বিদেশে পাচার করেছেন।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, অনুসন্ধান দল এ বিষয়ে দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ করছে এবং প্রমাণাদি সংগ্রহ শেষে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপরই কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
গত ১২ ডিসেম্বর দুদক জাহিদ মালেক ও তাঁর ছেলে রাহাত মালেকের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলায় বলা হয়েছে, জাহিদ মালেক ৬১ কোটি ৪২ লাখ ৫৬ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন এবং ৩৪টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
ছেলের সম্পৃক্ততা: ক্ষমতার অপব্যবহার ও শত শত কোটি টাকার লেনদেন
জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেকের বিরুদ্ধেও দুদক জানিয়েছে যে, তিনি আয়বহির্ভূত ১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদের মালিকানার পাশাপাশি ৫১টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ৬৬৩ কোটি ২৬ লাখ টাকার লেনদেন করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, পিতার সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমেই তিনি এই বিপুল অর্থ-সম্পদ অর্জন করেছেন।
৬ হাজার ৫৩ শতাংশ জমি ক্রয়
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জাহিদ মালেক ও তাঁর পরিবারের নামে ৬ হাজার ৫৩ শতাংশ জমির তথ্য পেয়েছে। মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন মৌজায় কেনা এসব জমির মধ্যে জাহিদ মালেকের নামে ২১৯৩.০৫৩ শতাংশ, ছেলে রাহাত মালেকের নামে ১৭৪২.০১৬ শতাংশ এবং মেয়ে সিনথিয়া মালেকের নামে ১১১৮.৭৮ শতাংশ জমি রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করছেন, এই বিপুল পরিমাণ জমির বাজারমূল্যও হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও রাজনৈতিক সুবিধা বিতরণ
গত ৭ মে প্রকাশিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে কিছু হাসপাতালে প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামের দাম ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও অপ্রয়োজনীয় ও নিম্নমানের স্থাপনা তৈরি করে লুটপাট এবং নতুন ভবন নির্মাণে অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রণালয় নিজেই উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতির চাহিদা তৈরি করে অর্থ অপচয় করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ২০২৪ সালের গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৫ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেট বেড়ে যাওয়ায় প্রভাবশালী মহল নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে লবিং শুরু করে। এমনকি মন্ত্রী পর্যায়েও এসব সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক সুবিধা বিতরণের অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে নির্মাণের স্থান ও প্রকৃতি নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও ঠিকাদাররা প্রভাব বিস্তার করে নিম্নমানের ও অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরি করেন।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) এর বিজ্ঞানী ও সংস্কার কমিশনের সদস্য আহমদ এহসানুর রহমান বলেন, “বৈশ্বিক বিবেচনায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ সর্বনিম্নে। এই কম বরাদ্দের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি ও দুর্নীতির সমস্যা থাকলে সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে প্রান্তিক জনগণ।”
২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন: ঠিকাদারী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় ৫১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারি আইন ও বিধি না মেনে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছে। ক্ষমতা ছাড়ার আগের তিন বছর চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের কাজ পেতে প্রতিটি কোম্পানিকে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়েছে। এই কমিশনের অর্থের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক শুভ্র নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অধিদপ্তরের কেনাকাটার নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সাল থেকে পরবর্তী তিন বছরে মোট ৭২টি দরপত্রে ৩১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বেশি চিকিৎসা যন্ত্র কেনা হয়, যার মধ্যে ২৪টি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে প্রভাবশালী ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর টেকনোক্র্যাট লিমিটেড কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পর তিনি আত্মীয়স্বজনসহ নামে-বেনামে অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা চালিয়েছেন। মিঠুর ভাগ্নের প্রতিষ্ঠান ট্রেড হাউস ১১টি প্যাকেজে ৫১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, রাহাত মালেক শুভ্রর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় দীর্ঘদিন ধরে একটি দুষ্টচক্র সক্রিয় ছিল। তাঁর সহযোগী ছিলেন অধিদপ্তরের সাবেক লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন। অভিযোগ রয়েছে, সরকার বা বিরোধীদলীয় যেই হোক না কেন, শুভ্র-তপন চক্রকে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন না দিয়ে কেউ কাজ পাননি। এমনকি দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকেও তাঁরা কাজ দিয়েছেন।