বিশেষ প্রতিনিধি॥
খুলনার তেরখাদা থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সরদার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, হয়রানি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি মামলায় তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নতুন করে জনমনে আলোচনা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বুধবার (২৫ জুন) খুলনার তেরখাদা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. গোলাম মোস্তফা ভুট্টো সরদার মোশাররফসহ ১০ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায়, ছিল ক্রসফায়ারের হুমকি:
বাদী গোলাম মোস্তফা ভুট্টো অভিযোগ করেছেন, সাবেক ওসি মোশাররফ বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন। তিনি নিজেও ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং টাকা না দিলে গ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ারের হুমকি দেন। মামলার অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২৩ সালের ২০ জুন এবং ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই ওসি মোশাররফ ও তার সহযোগীরা বাদীসহ একাধিক ব্যক্তিকে আটক করে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করেন। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার বহু মানুষ:
উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক চৌধুরী ফখরুল ইসলাম বুলু জানান, তার বাবা জালাল উদ্দিন চৌধুরী ২০১২ সালে মারা গেলেও তাকে ২০২৪ সালের একটি নাশকতা মামলায় আসামি করা হয়েছে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি বলে তিনি মনে করেন। পশ্চিম কাটেংগা এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, ওয়ারেন্ট বা কোনো অপরাধ ছাড়াই ওসি মোশাররফ তাকে আটক করে অর্থ দাবি করেন। টাকা না দিলে তাকে নাশকতার মামলায় জেলে পাঠানো হয় এবং কয়েক মাস কারাভোগের পরও তিনি কোনো বিচার পাননি। একই এলাকার তাজ মাহমুদ অভিযোগ করেন, ওসি মোশাররফ তাকে তিনটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করেন এবং কোনো অভিযোগ ছাড়াই থানায় আটকে রেখে মানসিক হয়রানি করেন। সিঙ্গাপুর প্রবাসী সবুজ খান জানান, ওসি মোশাররফ জমি সংক্রান্ত একটি বিষয়ে তার চরম ক্ষতি করেছেন, টাকা নিয়েও কাজ করেননি এবং উল্টো তাকে হয়রানি করেছেন।
বিতর্কিত অতীত এবং পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন:
সূত্র মতে, তেরখাদায় যোগদানের আগেও ওসি মোশাররফ রূপসা ও লবণচরায় দায়িত্ব পালনের সময় বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে তিনি জমি দখল, চাঁদাবাজি এবং বিচার-শালিসের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব অভিযোগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলেও রহস্যজনকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং, এমপি ও প্রভাবশালীদের সুপারিশে তাকে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ ওসি হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছে, যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। স্থানীয়দের তথ্যমতে, ওসি মোশাররফের সময় থানাকে চাঁদাবাজির কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো এবং নিরীহ মানুষদের উপর ভয়-ভীতি ও নির্যাতন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
ধর্ষকদের রক্ষায় অর্থ লেনদেন, ছাত্র-জনতার ক্ষোভ:
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলার বলর্দ্ধনা এলাকার এক বাকপ্রতিবন্ধী সনাতন ধর্মালম্বী গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার হলে ওসি মোশাররফ অর্থের বিনিময়ে ধর্ষকদের রক্ষা করেন এবং থানায় মামলা না নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ছাত্র-জনতার চাপে তিনি মামলা নিতে বাধ্য হন। কিন্তু ধর্ষণ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার না করায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ওসির প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধনও করেন।
পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ তাকে তেরখাদা থেকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করে। বর্তমানে চলমান মামলায় গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ওসি মোশাররফ হোসেন খুলনা জেলার পুলিশের ক্রাইম শাখায় কর্মরত আছেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের নীরবতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে জনমনে গভীর প্রশ্ন তৈরি করেছে।