আন্তর্জাতিক ডেস্ক॥
১৫ জুন, ২০২৫: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে, যা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বজুড়ে নতুন করে সংঘাতের অশনিসংকেত তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে সমর্থন জানালেও, সামরিক শক্তিধর চীন ও রাশিয়া ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইরান এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। গতকাল ভোরে ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ‘আয়রন ডোম’ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয় এবং তেল আবিবে অবস্থিত ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একই সময় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশে একের পর এক আঘাত হানতে থাকে।
১৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, ইসরায়েলের আয়রন ডোম একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে ক্ষেপণাস্ত্রটি আয়রন ডোম ধ্বংস করে চোখের পলকে প্রতিরক্ষা সদর দপ্তরে আঘাত হানে। ক্লিপটি শুরু হয় বিকট শব্দে বেরিয়ে আসা প্রজেক্টাইল দিয়ে, তারপর আলোর ঝলক এবং আগুনের একটি গোলা বিকট শব্দে ভবনটিতে আঘাত করে। আয়রন ডোম এবং প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দেওয়ায় তেল আবিবসহ তাদের মিত্ররা হতবাক হয়েছে। এ ঘটনার পর বলা হয়েছে, পরিস্থিতি খুব দ্রুত নাজুক হচ্ছে। সামরিক বিশ্লেষকরা শুধু মধ্যপ্রাচ্য বা আঞ্চলিক সংঘাত নয়, ব্যাপক পরিসরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
মধ্য ইসরায়েলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের সরাসরি আঘাত, হতাহতের আশঙ্কা
মধ্য ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। এতে বহু স্থাপনা ভস্মীভূত হওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এ ঘটনায় অন্তত দুজন নিহত ও ১৯ জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েল কাঁপছে।
এদিকে, ইরানে হামলার বিষয়ে বিস্ফোরক তথ্য পাওয়া গেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ দাবি করেছে, শুক্রবার ইরানের ভিতর থেকেই দেশটির নানা অবকাঠামোয় নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। এ সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেছে মোসাদ। নিহত সামরিক ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের অনেকেই বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন কিংবা অন্যান্য যন্ত্রের আঘাতে নিহত হন বলে দাবি করা হয়েছে।
গতকাল সকালে মধ্য ইসরায়েলের আবাসিক ভবনগুলোতে ইরানের সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে দুজন নিহত এবং ১৯ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবার এক মুখপাত্র। তিনি চ্যানেল ১২ নিউজকে জানান, আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর। আহত সবাইকে শামির মেডিকেল সেন্টার এবং উলফসন মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়েছে। এর আগে আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কাজ করছে এবং ইসরায়েলিদের নিরাপদ এলাকায় চলে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার স্থানীয় সময় ভোরে মধ্য ইসরায়েলে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কয়েকজন আহত এবং অনেক বাড়িঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসরায়েলে দেড় শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ইরানের
ইসরায়েলের হামলার পর ইরান পাল্টা হামলা হিসেবে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় ইসরায়েলের দিকে দেড় শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং ইরানি মিডিয়ার বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে জেরুজালেম পোস্ট ও রয়টার্স। তবে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী (আইএএফ) দাবি করেছে, তারা বেশির ভাগ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আকাশপথেই ভূপাতিত করেছে। আইডিএফ জানিয়েছে, তারা ইরানে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা অব্যাহত রাখবে। টেলিগ্রামে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে আইডিএফ জানিয়েছে, ইরানে ইসরায়েলের জন্য হুমকিস্বরূপ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে দেশটির বিমান বাহিনী। তাদের উদ্দেশ্য, ইসরায়েলের জন্য সব রকম হুমকি নির্মূল করা।
তেল আবিবে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা: ‘সবকিছু কাঁপছিল’
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে বড় বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। বিস্ফোরণগুলো এতটাই ভয়াবহ যে গোটা শহর কেঁপে ওঠে। এমনই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন এক ইসরায়েলি নাগরিক।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সবকিছু কাঁপছিল’—ইসরায়েলিরা তেল আবিবে ইরানের হামলার বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছে। ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর ইসরায়েলি দমকলকর্মীরা তেল আবিবের একটি উঁচু ভবনে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেন। ভুক্তভোগী এক বাসিন্দা চেন গ্যাবিজন বলেন, তিনি সতর্কতা পাওয়ার পর একটি ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থলে দৌড়ে যান। কয়েক মিনিট পর একটি খুব বড় বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। সবকিছু কাঁপছিল। ধোঁয়া, ধুলো ছিল সর্বত্র। তিনি বলেন, যথাসময়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে না পারলে তারা কেউ বেঁচে থাকতেন না।
ইরানে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত ও নারী পাইলট আটকের দাবি
ইরানে ইসরায়েলের দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তেহরান। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিমানের একজন নারী পাইলটকেও আটকের দাবি করেছে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এমন দাবি নাকচ করেছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র অ্যাভিকচে আদ্রেয়ি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে বলেন, ইরানের সংবাদমাধ্যম মিথ্যা বলেছে। এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে বিবিসি।
পাঁচবার বাংকারে আশ্রয় নেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যে একটি ‘কঠিন রাত’ পার করেছেন বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে পাঁচবার আশ্রয় কেন্দ্রে (বাংকারে) যেতে হয়েছে।’ হাকাবি আরও বলেন, আমাদের শান্ত থাকা উচিত। সম্ভবত আর কোনো হামলা হবে না। তবে পুরো জাতিকে আশ্রয় কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি একাধিক বক্তব্যে ইসরায়েলের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি।
ইসরায়েলের হুঁশিয়ারি: আরও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে তেহরান জ্বলবে
ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় আঞ্চলিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ইরান যদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রাখে, তাহলে তেহরানও জ্বলবে।’ ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে জরুরি বৈঠকের পর ইসরায়েল কাৎজ বলেন, ইসরায়েলি নাগরিকদের ওপর হামলার জন্য ইরানকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘যদি (ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি) ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলে তেহরান জ্বলবে।’ ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, দেশটির খোররামাবাদ, কেরমানশাহ ও তাবরিজ শহরে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে; যা সম্ভাব্য নতুন ইসরায়েলি হামলার ইঙ্গিত। তাবরিজ শহরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, শহরের আকাশে কালো ধোঁয়া উড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসরায়েলি এক সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েল আরও হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ হামলা এখনো শেষ হয়নি।
ইসরায়েল ও মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা অব্যাহত রাখার হুমকি ইরানের
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের হামলা অব্যাহত থাকবে। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ফার্স আরও জানিয়েছে, ‘গত রাতের সীমিত অভিযানে এ সংঘর্ষ শেষ হবে না। ইরানের হামলা অব্যাহত থাকবে। এ পদক্ষেপ আগ্রাসীদের জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও অনুশোচনীয় হবে।’ সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘এ যুদ্ধ আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার দখল করা সব অঞ্চল এবং অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে।’
মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসি সামরিক ঘাঁটিতে হামলার হুমকি ইরানের
ইরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে সহায়তা করলে তাদের ছেড়ে কথা বলবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। দেশটি বলেছে, ইসরায়েলকে সহায়তার পরিণাম হিসেবে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের যে সামরিক ঘাঁটি ও জাহাজ রয়েছে, সেগুলোতে হামলা করা হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আগে বলেছিলেন, ইসরায়েলকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করবে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন বাহিনী ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরানের ছোড়া ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ভূপাতিত করতে সাহায্য করেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁও শুক্রবার বলেছিলেন, তার দেশ ইরানের প্রতিশোধের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। তবে যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, তাদের বাহিনী ইসরায়েলকে কোনো সামরিক সহায়তা দেয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার উত্তেজনা কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত ইরানের এ হুমকি বাস্তবায়িত হলে তা হবে একটি বড় জুয়ার মতো। এতে পশ্চিমা সামরিক বাহিনী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক ম্যাককয় পিট সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘কোনো সরকার-সমর্থিত গোষ্ঠী বা স্বাধীনভাবে কাজ করা কেউই যেন মার্কিন নাগরিক, ঘাঁটি বা অন্য কোনো অবকাঠামোয় হামলা না করে। তাহলে ইরানের পরিণতি হবে শোচনীয়।’