বিশেষ প্রতিবেদক॥
বিলিয়ন ডলার সহায়তা ও ১ লাখ শ্রমিক নিয়োগের দ্বার উন্মোচন॥ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপান ‘জয়’ করে এসেছেন। এই সফরের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের জন্য এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে এক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে জাপানে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিতকরণ ও সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস
ড. ইউনূস গত ২৮ মে জাপান সফরে যান এবং শনিবার রাতে দেশে ফিরেছেন। এই সফরের মূল লক্ষ্য ছিল বিগত বছরগুলোতে কিছুটা স্থবির হয়ে পড়া বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে পুনরায় তার আগের উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। জাপান বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু, প্রধান উন্নয়ন সহযোগী, সর্বোচ্চ সাহায্যদাতা এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্বীকৃতিদাতা দেশ।
সফরকালে ড. ইউনূস জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।1 টোকিওর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জাতি গঠন প্রচেষ্টা, সংস্কার উদ্যোগ এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতি পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী ইশিবা উল্লেখ করেন যে, জাপানি জনগণ ড. ইউনূসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে এবং বাংলাদেশ যাতে তার চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা সফল হয়, সে জন্য টোকিও সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করবে।
ড. ইউনূস এই বৈঠকে জাপানের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমরা বড় বিপদের মধ্যে আছি। আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশ ১৬ বছরের একটি ভূমিকম্প পার করেছে। সবকিছু ভেঙে পড়েছে। আমরা এখন টুকরো টুকরো করে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।” তিনি জাপানকে বাংলাদেশের কঠিন সময়ের বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। উভয় নেতা চলতি বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) স্বাক্ষরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও গভীর করবে।
১.০৬৩ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক
প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফরকালে দেশটির পক্ষ থেকে ১.০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার আশ্বাস এসেছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবার সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠককালে এই প্রতিশ্রুতি আসে এবং এ বিষয়ে তিনটি চুক্তিপত্র বিনিময় হয়:
অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু পরিবর্তনের সহনশীলতা শক্তিশালীকরণে ডেভেলপমেন্ট পলিসি ঋণ (৪১৮ মিলিয়ন ডলার)
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েল-গেজ ডাবল লেন রেলপথ প্রকল্পের জন্য ঋণ (৬৪১ মিলিয়ন ডলার)
মানবসম্পদ উন্নয়ন বৃত্তির জন্য অনুদান (৪.২ মিলিয়ন ডলার)
এছাড়াও, এই সফরে মোট ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা অর্থনৈতিক, বিনিয়োগ এবং অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে প্রসারিত করবে।2 এই স্মারকগুলো জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি), অনোডা ইনক, বাংলাদেশ নেক্সিস কো. লিমিটেড, গ্লাগিট, মুসাসি সিমিতিসু ইন্ডাস্ট্রি গ্লাফিট, কিপার রকার কো. লিমিটেড এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, বিনিয়োগ উন্নয়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।
১ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের ঐতিহাসিক চুক্তি
ড. ইউনূসের জাপান সফরের অন্যতম বড় অর্জন হলো আগামী পাঁচ বছরে এক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের ঘোষণা। বৃহস্পতিবার টোকিওতে ‘বাংলাদেশ সেমিনার অন হিউম্যান রিসোর্সেস’ শীর্ষক সেমিনারে জাপানের সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষ এই ঘোষণা দেয়। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে এটিকে বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে:
বাংলাদেশের ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) এবং কাইকম ড্রিম স্ট্রিট (কেডিএস)-এর মধ্যে।
বিএমইটি এবং জাপানের ৬৫টি কোম্পানির ফেডারেশন জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-অপারেটিভস ও জাপান বাংলা ব্রিজ রিক্রুটিং এজেন্সি (জেবিবিআরএ)-এর মধ্যে।
এমআইডিআই মেগাসিটি এবং জাইকার সহযোগিতা
মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ (এমআইডিআই) ঘিরে সরকারের যে সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হচ্ছে, তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) প্রেসিডেন্ট ড. তানাকা আকিহিকো। ‘৩০তম নিক্কেই ফোরাম: এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সম্মেলনের সাইডলাইনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি এই ঘোষণা দেন।
ড. ইউনূস উল্লেখ করেন যে, এমআইডিআই অঞ্চল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে প্রতিনিধিত্ব করে। বঙ্গোপসাগরের প্রবেশাধিকারকে কাজে লাগিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর, মহাসড়ক এবং রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে, যা এমআইডিআই অঞ্চলকে নেপাল, ভুটান এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশের সাথে যুক্ত করবে। তিনি এই কাজে জাইকার সহযোগিতা কামনা করেন। ড. তানাকা আকিহিকো এমআইডিআই উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাইকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ড. ইউনূস আরও জানান যে, এমআইডিআই এলাকায় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রপ্তানিমুখী উৎপাদন কারখানা স্থাপন করতে পারবেন এবং এই অঞ্চলে একটি মেগাসিটি গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরকে অত্যন্ত সফল বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে, বিশেষ করে জাপানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া দেশের জন্য একটি বড় প্রত্যাশা পূরণ। তিনি জাপানকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু এবং বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে আশা প্রকাশ করেন যে, প্রধান উপদেষ্টা তার ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে এই সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।