শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ০৩:০৬ অপরাহ্ন
১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৪ঠা জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি
শিরোনাম :
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাত বার্ষিকী পালিত কৃষি ও ভূমি সংস্কার বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত ফরিদপুরে ঈদ কে সামনে রেখে জেলা প্রশাসকের কার্যলয় এক সভা অনুষ্ঠিত ফরিদপুরে জজ আদালতে হত্যা মামলায় ৪ জনের যাবজ্জীবন প্রধান উপদেষ্টা জাপানের পথে: ‘ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগদান ও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক জমি বিক্রি করে অর্থ পাচার: ক্ষমতাধরদের পলায়ন ও সম্পদের হাতবদল সচিবালয় এলাকায় সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ: ডিএমপি’র কড়া নির্দেশনা পদত্যাগের গুঞ্জন নাকচ দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা বিপদেও আছে কল্যাণ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি, তিন উপদেষ্টার অব্যাহতি দাবি

জমি বিক্রি করে অর্থ পাচার: ক্ষমতাধরদের পলায়ন ও সম্পদের হাতবদল

Coder Boss
  • Update Time : বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫
  • ৮ Time View

অনলাইন ডেস্ক ॥
ঢাকা, ২৮শে মে ২০২৫ — আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ক্ষমতা ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে মন্ত্রী, এমপি, আমলা, নেতা, পাতিনেতা এবং এলাকার “বড় ভাই” হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা যে যেভাবে পেরেছেন, জমি কিনেছেন বা দখল করেছেন। অসহায় মানুষের জমি কখনো নামমাত্র মূল্যে, কখনো বা জোর করে লিখে নিয়েছেন। ক্ষমতা হারানোর পর এদের অনেকেই এখন পলাতক; কেউ দেশে আত্মগোপনে, আবার কেউ আরব আমিরাত, কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়েছেন।

বিক্রিত জমির অভিযোগ ও অনুসন্ধান
অভিযোগ উঠেছে, এই পলাতক নেতারা এখন নিজেদের নামে-বেনামে কেনা জমিজমা যে যেভাবে পারছেন, বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার রাজউক-পূর্বাচল নতুন শহর, রূপগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার সহ বিভিন্ন স্থানেই জমি বিক্রির এমন ঘটনা ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ, সাবেক ডিবিপ্রধান মনিরুলের গাজীপুরে ৯ বিঘা জমি বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

রূপগঞ্জের চিত্র: হারেজ ও অন্যান্য নেতার প্লট বিক্রি
রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হারেজ ক্ষমতা ব্যবহার করে প্লটের ব্যবসা করতেন। তার নামে-বেনামে প্রায় ২০টি প্লট রয়েছে। ৫ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর তিনিও এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। চলতি বছরের ২ মার্চ তার পাঁচ কাঠার একটি প্লট বিক্রি করে সেই টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন বলে স্থানীয়দের ধারণা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সাধারণ মানুষের এসব প্লট আওয়ামী লীগের শাসনামলে মন্ত্রী, এমপি, নেতাকর্মী ও সচিবরা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং এখন পানির দামে কেনা এসব প্লট চড়া দামে বিক্রি করে বিদেশে টাকা পাচার করা হচ্ছে। শুধু হারেজ নন, গোলাম দস্তগীর গাজীর পছন্দের নারী নেত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা মারফত আলী, রূপগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন ভূঁইয়া, কালীগঞ্জের সাবেক সাবেক চেয়ারম্যান অলিউর রহমান এবং যুবলীগ নেতা শাহীন মালুম সহ অনেকের প্লট বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। গত আট মাসে রূপগঞ্জ উপজেলার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাবিবুর রহমান হারেজ ব্রাহ্মণখালী এলাকায় ২০টির মতো প্লট হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র দামে হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি পাঁচ কাঠার প্লট তিনি গত ২ মার্চ তানিয়া সুলতানা নামের এক নারীর কাছে বিক্রি করেছেন। এই প্লট বিক্রির রেজিস্ট্রি ঢাকায় হয়েছে।

পূর্বাচলের প্লট বিক্রি: সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য
রূপগঞ্জ পশ্চিম সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে চলতি বছরের ১৫ মে পর্যন্ত পূর্বাচল উপশহরে ২৬৯টি প্লট রেজিস্ট্রি হয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গোপনীয়তার কারণে এসব রেজিস্ট্রির বেশিরভাগই কমিশনে রেজিস্ট্রি হয়েছে। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির প্লট তাদের নিজের নামে না থাকলেও স্বজনদের নামে রয়েছে। গত ৯ মাসে পূর্বাচলের প্লট বিক্রির পরিমাণ গত দুই বছরের তুলনায় অনেক বেশি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পদের হাতবদল
দাউদপুর ইউনিয়নের যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহীন মালুম আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্লট বাণিজ্য করে রাতারাতি সম্পদশালী হন। তার ও তার স্ত্রীর নামে পূর্বাচলে অন্তত ১০টি প্লট রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তিনি শিমুলিয়া মৌজায় ৪০ শতাংশ জমি বিক্রি করে দিয়েছেন এবং আরও জমি বিক্রির চেষ্টা করছেন।

দাউদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক মারফত আলী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে ভয় দেখিয়ে প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন। ১৭ নম্বর সেক্টরে তার একটি প্লট ছিল, যার বর্তমান বাজারদর দুই কোটি টাকা। ৫ আগস্টের পর তিনিও পালিয়ে গেছেন এবং কিছু জমি বিক্রি করেছেন।

পূর্বাচলের কূটনৈতিক জোনে তারেক সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী শাহনাজ সিদ্দিকীর নামে ১০ কাঠার দুটি প্লট বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। সাবেক স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলাল উদ্দিন সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট বিক্রি করতে মধ্যস্থতাকারীদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়াও একজন সরকারি কর্মকর্তা ১১ নম্বর সেক্টরে তার তিন কাঠার একটি প্লট বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার মূল্য প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা।

দালালদের দৌরাত্ম্য ও আদিবাসীদের অভিযোগ
পূর্বাচলের প্লট ব্যবসাকে ঘিরে ছোট-বড় কয়েকশ মধ্যস্থতাকারী (দালাল) সক্রিয়। এদের মাধ্যমে জানা গেছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্লটগুলো সাধারণত কমিশনে রেজিস্ট্রি হয় এবং বেশিরভাগই স্বজন বা বেনামে নেওয়া। বর্তমানে প্লটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্লট বিক্রির পরিমাণ অনেক বেড়েছে।

স্থানীয় আদিবাসীরা অভিযোগ করেছেন, পূর্বাচলের প্লট পাওয়ার কথা ছিল আদিবাসী ও সাধারণ মানুষের, অথচ যারা পাওয়ার যোগ্য নয়, তারাই প্লট পেয়েছেন। তাদের দাবি, রাজউকের উচিত ছিল প্লট বিক্রি না করে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রি করা, তাহলে এত হরিলুট হতো না।

কালীগঞ্জের অলিউল ইসলামের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ
কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও নাগরী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ অলিউল ইসলাম অলি রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক না হয়েও ৬৩টি প্লট বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি তার স্ত্রী, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাইয়ের স্ত্রী, শ্যালিকা সহ আত্মীয়-স্বজনের নামে প্রায় ১২৬ কোটি টাকার প্লট জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছিলেন। স্থানীয় আদিবাসীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২১ সালের অক্টোবরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক অলি গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক এবং বর্তমানে আমেরিকায় আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ডিবি মনিরুলের গোপন সম্পদ বিক্রি
আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম, যিনি ডিবি মনিরুল নামে পরিচিত, তার গাজীপুরের কালীগঞ্জে মাছের খামার ও বিস্তর জমি রয়েছে। এসব সম্পদ তিনি স্বজন ও বিশ্বস্তদের নামে কিনেছিলেন। সম্প্রতি তার ৯ বিঘা জমি গোপনে বিক্রি করে টাকা তার কাছে পাঠানো হয়েছে। এই লেনদেনের দায়িত্বে ছিলেন তার বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার আ. মোমেন। ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে মনিরুল ইসলাম প্রায় ৯ বছর ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশে ছিলেন এবং পরে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান এবং সর্বশেষ অতিরিক্ত আইজিপি মর্যাদায় এসবিপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং পরে তাকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

গাজীপুরের রয়ান গ্রামে মনিরুলের প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে ‘জুনায়েদ অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামের একটি মৎস্য ও গরুর খামার রয়েছে, যার কাগজে-কলমে মালিক আ. মোমেন হলেও মূল মালিক মনিরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী শায়লা ফারজানা। রয়ান ছাড়াও চানখোলা, পাঞ্জোরা ও বাগুরদা মৌজায় তার স্ত্রী শায়লা ফারজানা ও শ্যালক রেজাউল আলম শাহীনের নামে প্রায় ১৭ বিঘা কৃষিজমি রয়েছে। এছাড়া পূর্বাচলের ২৭ নম্বর সেক্টরে মনিরুল এবং তার স্ত্রী ও শ্যালকের নামে ১০ কাঠার চারটি প্লট রয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৮০ কোটি টাকার বেশি। জানা গেছে, মনিরুল আত্মগোপনে থাকায় জমি রেজিস্ট্রি হয়নি, তবে সুবিধাজনক সময়ে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে জমি বিক্রি করা হয়েছে।

এই ঘটনাগুলো দেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তা বিদেশে পাচারের এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছে। এই অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102