মনিরুজ্জামান মনির, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
একটি বক্তব্য, একটি জাগরণ—এনজিও ঋণের চেহারা নিয়ে প্রফেসর ইউনূসের নতুন বার্তা “মাইক্রোক্রেডিট এখনো এনজিও পর্যায়েই আছে, এটি ব্যাংক হতে হবে”—এই কথাটি যখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ক্ষুদ্রঋণ প্রবক্তা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন তখন তা নিছক একটি পরামর্শ নয়। এটি একটি যুগান্তকারী উপলব্ধি। এটি একটি মৌলিক স্বীকারোক্তি যে, এতদিন এনজিও-নির্ভর ঋণব্যবস্থা সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে যতটা সহায়ক ছিল বলে দাবি করা হয়েছে, বাস্তবে ততটাই অকার্যকর ও ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।
আগারগাঁওয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর এই বক্তব্য কেবল দারিদ্র্য বিমোচনের বর্তমান ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং এনজিও-ব্যাংকিংয়ের নামে গড়ে ওঠা একধরনের অপশাসনের দিকেও ইঙ্গিত করে—যেখানে গরিব মানুষ না পায় মুক্তি, না পায় মর্যাদা, পায় শুধু কিস্তির চাপে অসহায়ত্ব আর অপমান।
মাইক্রোক্রেডিট: দারিদ্র্য বিমোচনের ‘বাণিজ্যিক মুখোশ’
দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে গ্রামীণ ব্যাংক মডেল বা তার ভিত্তিতে পরিচালিত এনজিও-সমূহ গরিব মানুষের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মাধ্যমে একটি বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। “সেবা” ও “উন্নয়ন” শব্দের আড়ালে এগুলো কার্যত সুদে টাকা দিয়ে কিস্তিতে আদায় করা এমন এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে যেখানে একটি দরিদ্র পরিবার একবার ঋণ নিলে আর বের হতে পারে না। মাসে মাসে চড়া সুদে কিস্তি শোধ করতে গিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, গবাদি পশু, এমনকি ঘরের চাল পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়। স্বামীর চিকিৎসা, সন্তানের পড়াশোনা, এমনকি খাবার কেনার টাকা দিয়েও এনজিও কর্মীদের কিস্তি আগে শোধ করতে হয়। গ্রামীণ ব্যাংক পথ দেখালেও এখন হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে কতশত এনজিও যে এসেছে তার নাম বোধহয় দায়িত্বশীলরাও তালিকা না দেখে বলতে পারবে না। এমনকি বিভিন্ন সমবায় সমিতিও এনজিও নাম দিয়ে মূলত চড়া সুদের এই ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে। টাকা নেয়া গ্রাহকরা কিস্তি দিতে না পারলে চরম অপমান, অপদস্ত এমনি মারধরের ঘটনাও ঘটে। ঘরের আসবাবপত্র ছিনিয়ে আনা থেকে শুরু করে মামলা-হয়রানি তো আছেই। তথাকথিত এসব এনজিও’র উদ্যোক্তার কোটি কোটি টাকা লাভবান হলেও সাধারণ মানুষ সুদের ঘানি টানতে টানতে দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো: এই যদি হয় উন্নয়ন, তবে তা কাদের জন্য?
‘ব্যাংক না হলে বিপর্যয়’—ড. ইউনূসের রেফারির দৃষ্টান্ত: গভীর তাৎপর্য। প্রফেসর ইউনূস তাঁর বক্তব্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ টানেন—“আপনি যদি ইউরোপিয়ান ফুটবলের রেফারিকে দিয়ে আমেরিকান ফুটবল চালাতে বলেন, তাহলে বিপর্যয় ঘটবে।” তিনি মূলত বুঝাতে চেয়েছেন— বাংলাদেশ ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান নয়, যা এনজিও ধরনের মাইক্রোক্রেডিট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এজন্য তৈরি করা হয় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ)। কিন্তু এমআরএ-এর নিয়ন্ত্রণ কার্যকারিতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁর এই বক্তব্য আজকে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা বহন করে—নিয়ন্ত্রণের অভাবে, শোষণই নিয়মে পরিণত হয়েছে।
আত্মহত্যার বিভীষিকা: ঋণ শোধ করতে না পেরে প্রাণ বিসর্জন
প্রশ্ন হচ্ছে—এই এনজিও ঋণের চাপে গরিব মানুষ কী পরিণতির শিকার হচ্ছে? পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা: ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ২৮৭ জন দরিদ্র মানুষ এনজিও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, মাগুরা—দেশজুড়ে বহু আত্মহত্যার খবর সংবাদপত্রে এসেছে। আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগই ছিলেন গৃহিণী, কৃষক ও দিনমজুর; যাঁরা বারবার বলেছিলেন—“কিস্তির চাপে বাঁচা যাচ্ছে না।”
মানবিক সংকট:
এই আত্মহত্যাগুলো নিছক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সংকট নয়; এটি একটি সামাজিক ব্যর্থতা, একটি অর্থনৈতিক নিপীড়নের ফলাফল।
আইন ও নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এনজিও ব্যাংকিং
১. সংবিধান লঙ্ঘন
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) ও ১৮(১) ধারা অনুযায়ী, জনগণের মৌলিক চাহিদা ও সামাজিক নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। কিন্তু— এনজিওর এই ঋণ ফাঁদ মানুষকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করে। অসুস্থ স্বামীকে চিকিৎসা না করিয়ে মানুষ কিস্তি শোধে বাধ্য হয়।
২. আন্তর্জাতিক নীতিমালা লঙ্ঘন
UN Guiding Principles on Business and Human Rights অনুযায়ী— প্রতিটি আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ এনজিও এসব নিয়ম মানে না, বরং তাদের ব্যবস্থাপনা থাকে স্বেচ্ছাচারী।
৩. এমআরএ: কী নিয়ন্ত্রক, না লোক দেখানো প্রতিষ্ঠান?
যদিও প্রফেসর ইউনূস এমআরএ তৈরির মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, বাস্তবে—
এমআরএ নিজেই এখন বড় বড় এনজিওর ছায়ায় চলে। সুদের হার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। গ্রাহকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
একটি নতুন কাঠামোর প্রয়োজন: ব্যাংকিং মডেল ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
প্রফেসর ইউনূসের আহ্বানকে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন:
১. পৃথক ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক আইন’ প্রণয়ন: এনজিওদের ব্যাংক হিসেবে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। সর্বোচ্চ সুদহার ১২% নির্ধারণ। গ্রাহকের সম্মান রক্ষায় আইনগত সুরক্ষা।
২. গ্রাহক সুরক্ষা ও অভিযোগ কেন্দ্র: প্রতিটি উপজেলায় অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র স্থাপন। জেলাভিত্তিক নজরদারি কমিটি গঠন।
৩. ঋণ পুনঃতফসিল ও প্রশিক্ষণ: ঋণ খেলাপি হলে পুনঃতফসিলের সুযোগ। গ্রাহক ও কর্মীদের জন্য আর্থিক নৈতিকতা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক।
ড. ইউনূসের উপলব্ধি যেন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়:
প্রফেসর ইউনূস তাঁর বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য স্বীকার করে নিয়েছেন—এনজিওভিত্তিক ঋণ কাঠামো যথেষ্ট নয়, বরং তা সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
এখন সময় এসেছে এই স্বীকারোক্তিকে রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে— এনজিও নির্ভর মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থার মুখোশ খুলে দেওয়া, গরিব মানুষের মর্যাদা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর ‘উন্নয়ন’ শব্দের অপব্যবহার করে দারিদ্র্যকে পুঁজি বানানোর ঘৃণ্য ব্যবসা বন্ধ করা।
“দারিদ্র্য বিমোচনের নামে যদি কেউ দারিদ্র্যকেই টিকিয়ে রাখে, তবে তা উন্নয়ন নয়—তা একধরনের ‘উন্নয়নের ছদ্মবেশে শোষণ’। ইউনূস যদি তাঁর বিবেক দিয়ে এটি বুঝতে পেরে থাকেন, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখন এই চক্র ভাঙা।”