নিজস্ব প্রতিবেদক॥
সরকার শনিবার (১০ মে) রাতে এক জরুরি বৈঠকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির ও এর নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তটি গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিচার এবং তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধের দাবিতে চলমান বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে। এর আগে, গত বছর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে একই আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বৈঠক শেষে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান যে উপদেষ্টা পরিষদে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীর অনুমোদন। এই সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল এখন কোনো রাজনৈতিক দল, তাদের সহযোগী সংগঠন বা সমর্থকদের শাস্তি দিতে পারবে। উপদেষ্টা পরিষদ মনে করে, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের কর্মী এবং ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম, এমনকি সাইবার স্পেসেও, নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন শীঘ্রই জারি করা হবে। এছাড়াও, আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য এবং সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণের খবর পাওয়া গেছে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি তার সমর্থকদের রাজপথে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মতামত জানাবেন বলে উল্লেখ করেছেন। এর আগে তিনি আরও লিখেছিলেন যে তাদের তিন দফা দাবির একটিও বাস্তবায়িত না হলে তারা রাজপথ ছাড়বেন না।
উল্লেখ্য, গত বুধবার সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগের পর থেকে এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগের বিচার ও রাষ্ট্রদ্রোহী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দেয়। ইসলামী ছাত্রশিবির, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ), হেফাজতে ইসলাম ও জুলাই মঞ্চের নেতা-কর্মীরাও এই বিক্ষোভে অংশ নেন।
এই পরিস্থিতিতে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানায় যে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে, সরকার আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন বিবেচনায় রাখছে। সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। এই প্রেক্ষাপটে শনিবার রাত ৮টায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সন্ধ্যায় এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে এক ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণা না এলে তারা আবারও ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করবেন। ঘোষণা না আসায় রাত ৯টার কিছু আগে আন্দোলনকারীরা যমুনার দিকে যাত্রা শুরু করলে পুলিশ তাদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে আটকে দেয়। তখনও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক চলছিল, যা রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত চলে। এরপর আইন উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানান।
অন্যদিকে, উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যা থেকেই সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ানো হয়। বাসভবনের প্রধান ফটকের ভেতরে সেনাবাহিনী ও সামনে পুলিশ মোতায়েন ছিল। র্যাব সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গেটের বাইরে সাদা পোশাকেও প্রচুর সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য টহল দিচ্ছিলেন। এদিন সচিবালয় এলাকায়ও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগেই আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধ করতে সন্ত্রাস দমন আইন প্রয়োগ করা হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় অভ্যন্তরীণভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা পেলেই দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জামায়াতকে যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, একই আইন প্রয়োগ করে আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করা হবে। তবে কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহারের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
এর আগে, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে, কারণ দলটির গঠনতন্ত্র দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশব্যাপী আন্দোলনের সময় সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে জামায়াতকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ করে। একই বছর জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও নিষিদ্ধ হয়, যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রমাণের অভাবে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।